‘প্রবাসে ইফতার করলেও মন পড়ে থাকে দেশে’

মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে মহিমান্বিত মাস হলো ‘রমজান’। আর এ মাসের রহমতের ১০ দিন শেষে শুরু হয়েছে, মাগফেরাতের ১০ দিন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় বিশ্বের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজেদের পবিত্র রেখে পুরো মাস সিয়াম সাধনা করেন। মাহে রমজান ঘিরে মালয়েশিয়ায় প্রতি বছর থাকে বাহারি ইফতারের বিশেষ আয়োজন।
দেশটির, সেলাঙ্গর-শাহ আলম, পেনাং, কোয়ান্তান, মেলাকা, জোহর, পিনাং ও রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ প্রতিটি রাজ্যে চলে ইফতার মেলা। মারদেকা মাঠেও করা হয় ইফতারের বিশেষ আয়োজন। এছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে আয়োজন করা হয় ফ্রি ইফতারের। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে সেই ইফতার করেন।
স্থানীয়রা ইফতার করেন বিভিন্ন ধরনের হাতে বানানো পিঠা, হালুয়া জাতীয় নাশতা, সাদা ভাত, ফলমূলসহ মালয়েশিয়ান খাবার দিয়ে। সঙ্গে থাকে আম, তরমুজ, বাঙ্গি, কলা, পেঁপে, আপেল, আঙুর, কমলাসহ নানা রকম ফল। এ মাসে বেশ অতিথি পরায়ণ হয়ে ওঠেন মালয়েশিয়ানরা।
রমজানে মুসলমানদের দিনে প্রকাশ্যে খাওয়া মালয়েশিয়ার আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রতিবছর এ অপরাধে আটক হন অনেকে। এছাড়া পুরো রমজানে সরকারি নজরদারিতে জিনিসপত্রের দাম অন্যান্য সময়ের থেকে কম রাখা হয়। এ মাসে মসজিদগুলোয় প্রতি ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যায়। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও নামাজ আদায় করতে যান মসজিদে। নামাজের পর কোরআন তেলাওয়াত করতে পছন্দ করেন মালয়েশিয়ানরা। মসজিদে মসজিদে ইফতারে বিনামূল্যে শরবত ও বুবুর বা নরম খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকে।
রমজানে মালয়েশিয়াতে সরকারি অফিস, আদালত স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় ছুটি হয়। ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণীয় ছাড় ঘোষণা করে শপিংমলগুলো। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার ধুম।
বাঙালিয়ানা আতিথিয়েতায় প্রবাসীদের ইফতার
শত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীদের মুখে আনন্দ ভেসে ওঠে। দেশীয় খাবার ছাড়া ভিনদেশি খাবারে ইফতার জমে না বাঙালিদের। সুদূর প্রবাসে থেকেও ইফতারে বাঙালি খাবারই তাদের প্রথম পছন্দ। প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত কোতারায়াতে রাস্তায় জমতো বিশাল জামায়াত। চিরচেনা কোতারায়ায় এখন আর নেই প্রবাসীদের জমাট আড্ডা। অভিবাসন বিভাগের ব্যাপক ধরপাকড়ের কারণে জনশূন্য হয়ে পড়েছে কোতারায়া।
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা সারাদিন কঠিন কাজ করার পরও রোজা রাখছেন। সিয়াম পালন করার পর প্রবাসীদের হোটেল-রেস্তোরাঁ, কাজের ফাঁকে বা বাসায় চলে বাঙালিয়ানা আতিথিয়েতায় ইফতারের আয়োজন।
ইফতারের সময় বাংলাদেশি যারা যেখানেই থাকেন বা কাজ করেন, তারা সেখানেই বিভিন্ন প্রকারের হাতে বানানো পিঠা, হালুয়া, সাদা ভাত, বিরিয়ানি, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, মরিচা, আলুচপ, জিলাপি, হালিম, খেজুর, আম, তরমুজ, কলা, পেঁপে, আপেল, আঙ্গুর, অরেঞ্জ ও মালয়েশিয়ানসহ নানা খাবার দিয়ে একসঙ্গে ইফতার করেন। তাই বাংলাদেশিদের আয়োজনটা বড় হয়। বাঙালিদের ইফতারের বিশাল আয়োজন দেখে মালয়েশিয়ানরাও অভিভূত।
প্রবাসী মো. নূরু বলেন, ‘প্রবাস জীবনে এটিই ছিল অনেক আনন্দের ইফতার। বাসার সবাই একসঙ্গে ইফতার করলাম। তবে এই আনন্দের মাঝেও দেশে থাকা পরিবারের সবাইকে অনেক মিস করছি। তাদের সঙ্গে মজা করে ইফতার করার যে সুখ, তা কোনোদিনও প্রবাস জীবনে হবে না।
নূরু বলেন, পবিত্র মাসে রোজা পালনের কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। এগুলো হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাকওয়া অর্জন, জান্নাতের আশা, পাপ থেকে দূরে থাকা, আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা, গুনাহ থেকে মার্জনা লাভ করা, জ্ঞান অর্জন, বিনয় ও নম্রতা শিক্ষা, লোভ-লালসা কমানো, নিজেকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় ও অশ্লীল কর্মকাণ্ড ও কথা থেকে বিরত থাকা।
বৃহস্পতিবার ইফতারের আগে কথা হয় মঈনুল ইসলাম নামে এক প্রবাসীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ইফতার সামনে নিয়ে বসতেই দেশে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবার কথা স্মরণ হয়ে যায়। প্রবাসে ইফতার করলেও মন পড়ে থাকে দেশে। পরিবারের সবাই কি দিয়ে ইফতার করছেন, দেশে থাকতে ঠিক এ সময় বাবা বাইরে থেকে কত কিছু নিয়ে আসতেন, মা অনেক যত্ন করে ইফতার পরিবেশন করাতেন; এগুলো মনে পড়ে। এখন প্রবাসে ইফতার নিয়ে বসে খুঁজে বেড়াই তাদের। মা-বাবা, ভাই-বোনকে আমি অনেক মিস করি।
প্রবাসী আমির হোসেন বলেন, দেশে থাকতে এলাকার তরুণদের সামাজিক সংগঠন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ৬ নং আদমপুর ইউনিয়নের প্রবাসী কল্যাণ সংগঠনের উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করতাম। আজ মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতি। প্রবাসে এসে সবাইকে মিস করছি।
জেডএইচ/জিকেএস