বাংলাদেশ ২.০

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন সত্যি হবে তো?

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৩৭ এএম, ১২ আগস্ট ২০২৪
সৈয়দ জাকির হোসাইন

পথিক কাজী

সময়টা ছিল বিএনপির শাসনামল। বাংলাদেশ তখন প্রতি বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতো। জাতি যেন নিমজ্জিত ছিল এক ঘোর অন্ধকারে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকের কথা। আমার স্ত্রী তখন ৯ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। এমন সময় চলছিল তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলন। তারা বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। ঢাকায় চলছিল হরতাল। গাড়ি বের হলেই ভেঙে দিচ্ছিল পিকেটাররা, অ্যাম্বুলেন্সকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছিল না।

বিজ্ঞাপন

সরকার (তৎকালীন বিএনপি) তার ক্ষমতা ছেড়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নির্বাচন হতে দেবে না। বিরোধী দল দাবি আদায় করে ছাড়বে যে কোনো মূল্যে। বঙ্গবন্ধুর চিরভক্ত এই আমি তখন আওয়ামী লীগকে শাপ-শাপান্ত করছিলাম। আমার স্ত্রীকে নিয়ে সেই দুর্যোগে কীভাবে হাসপাতালে যাব, তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় ১১ জানুয়ারি রাতে এলো এক সারপ্রাইজ।

সেটাকে সবাই ১/১১ নামে ডাকে। আমি ডাকি মুক্তির দিন। একদিকে লুটেরা সরকার (হাওয়া ভবন ছিল তাদের সাম্রাজ্যের হেড কোয়ার্টার), অন্যদিকে জেদী বিরোধী দল (ক্ষমতায় যাওয়াই ছিল যাদের মূল লক্ষ্য)। এদের হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিলো সেনাবাহিনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তখন দৈনিক প্রথম আলোতে আমার প্রথম প্রবন্ধটি ‘বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন সত্যি হবে তো?’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। এরপর ‘বদলে যাও-বদলে দাও’ ব্লগে অনাচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখেছি বিস্তর। কিছুই অর্জন করতে পারিনি। থাক সে কথা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ বছর (২০২৪) এপ্রিলের শেষে সপরিবারে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখছিলাম, বাংলাদেশের সমবয়সী একটা দেশ কত উন্নত। ওদের আধুনিক ও স্বচ্ছ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সুউচ্চ সব অট্টালিকা, ঝকঝকে রাস্তা, সযত্নে সংরক্ষিত প্রকৃতি ও পরিবেশ আর মানুষের চমৎকার আচরণ আমাকে বারবার মুগ্ধ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, ডা. মাহাথিরের মতো একজন নেতা পেলে বাংলাদেশ আজ কত এগিয়ে যেতো! অবশ্য আমাদের মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চড়ে আমার হৃদয় উদ্বেলিত হয়। পদ্মাসেতুতে চড়ে স্মৃতির শহর খুলনায় যাবার সময় আবেগে উচ্ছ্বসিত হই। কিন্তু এবার দেশে ঘটে গেলো বিশাল এক বিপ্লব, স্বপ্নে বুক বাঁধার মতো অনেক বড় একটি ঘটনা।

জুলাই মাসের শুরুতেই কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন দানা বাঁধছিল, আমি তখন নতুন একটি বেসরকারি চাকরিতে সদ্য যোগ দিয়েছি। দিন কাটছিল সীমাহীন ব্যস্ততায়। দেশের খবর রাখছিলাম ভাসা ভাসা। মনে মনে চিরকাল আমি কোটাকে ঘৃণা করেছি মেধার অবমূল্যায়ন হয় বলে। তাই হঠাৎ যেদিন কানে এলো, এই আন্দোলনকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং সরকারপ্রধান, আমি শুরুতে অবাক হলাম, পরে বুঝলাম তিনি চান একটা তাবেদার ও মেধাহীন রাষ্ট্রযন্ত্র গঠন করতে, যারা আজীবন ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’ এর মতো মন্ত্র জপতে থাকবে।

এরপর যখন তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি’ বলে কটাক্ষ করলেন, বুঝলাম, তিনি এই তরুণ প্রজন্মকে তৃণসম মূল্য দেন। ছাত্রদের তৃণ (ঘাস)-এর মতো পদদলিত করতে তার সেই হেলমেট বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া, পুলিশকে পথে পথে গুলি করার নির্দেশনা এবং ফলশ্রুতিতে সাঈদ, মুগ্ধ, প্রিয়সহ শত শত প্রাণের আত্মাহুতি আমাকেও মনে মনে বিদ্রোহী করে তুললো। হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষের ঢল আমাকেও মর্মে মর্মে আহত করলো। আমি তবু নিশ্চুপ। কারণ আমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছে। আমার জন্য সকল প্রকার লেখালেখি আজ নিষিদ্ধ। এই লেখাটিও তাই ছদ্মনামে লিখছি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মনে পড়ছে, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে আমি সরকারের বিরোধিতা করে ফেসবুকে কবিতা লিখে ও ছাত্রদের প্রেরণা দিতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া, ইলিশ পাঠানো বা ভারতীয় তারকা দিয়ে কনসার্ট করে বাংলাদেশে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাকে উদ্বিগ্ন ও উত্যক্ত করেছে বারবার।

এরও আগে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছলা-কলায় যে কাউকে যে কোনো সময় স্তব্ধ করে দিয়েছেন, আমার মন বিদ্রোহ করেছে (আমিও লেখার স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম)। কোনো দিন প্রকাশ করার সাহস পাইনি। ২০০৯ সালে বিডিআর ট্রাজেডি বা ২০১২ সালে সাগর-রুনি হত্যা আমাকে সরকার বিদ্বেষী করেছে। তবে সসেব মনের গোপনে। আয়নাঘরের নাম শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে গিয়েছে বহুবার।

মনে পড়ে যায় হীরক রাজার সেই ‘যন্তর-মন্তর ঘর’। আমি তবু চিরকাল শান্ত ছিলাম। ভারতীয় ঋণের টাকায় দেশের ১২টি জেলায় বিলাসবহুল হাইটেক পার্ক নির্মাণের প্রকল্পের সাথে আমি সরাসরি যুক্ত ছিলাম। প্রত্যক্ষ করছিলাম কী বিপুল অর্থের অপচয় ও পাচার করার এক নীল নকশা ছিল সেটি। সে প্রসঙ্গ আজ থাক।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ এর এই জুলাই মাসটা যেন মহাকালের এক অবিস্মরণীয় এক ফালি অন্ধকার, যা সূর্যগ্রহণের মতো গোটা পৃথিবীকে সাময়িকভাবে ঢেকে দিয়েছিল নিকষ কালো আঁধারে। প্রতিদিন এত এত প্রাণ যায়, জুলাই মাস যেন ফুরায় না। সেই লাঠিচার্জ-টিয়ার শেল, সেই ছররা গুলি, সেই গণগ্রেফতার, সেই ব্লক রেইড, সেই অপহরণ, সেই সব মিথ্যাচার জাতি চিরকাল ঘৃণা ভরে স্মরণ করবে।

শত শত প্রাণ কেড়ে নিয়ে টিভিতে প্রদর্শিত হলো মাছের মায়ের পুত্রশোক। আমি জীবনে যা করিনি, তাই শুরু করলাম। দোয়া করতাম প্রতি রাতে নামাজের পর বিশেষ সিজদায়। আমার মতো কোটি মানুষ তাই করেছেন, আমি জানি। তাইতো অবশেষে এলো চূড়ান্ত বিজয়। দিনটাকে ২০২৪ সালের ক্যালেন্ডার বলে ৫ আগস্ট, আমরা বলি ‘৩৬ জুলাই’। সেদিন সকালে আমি ও আমার পরিবার লাউড স্পিকারে জাগরণের গানগুলো শুনছিলাম।

‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে/অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে’ শুনে ধমনীতে রক্ত ফুটছিল টগবগ করে। হালের ইউটিউবের ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি?’ যেমন শুনছিলাম, ১৯৭১ এর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ ও শুনছিলাম। কখনও বা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনছিলাম, কখনও বা নিজেই শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ আবৃত্তি করছিলাম। এসবের মাঝখানেই এক সহকর্মী ফোন করে জানালেন, স্বৈরাচার পতনের সেই অতি কাঙ্ক্ষিত সুসংবাদ। টিভি খুলে সেটা নিশ্চিত হবার পর আমি ছুটে গেলাম মিষ্টির দোকানে...।

বিজ্ঞাপন

অথচ আমার পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। দেশ পরিচালনায় তার ব্যর্থতা ভুলে আমরা স্বাধীনতার ডাক দেওয়া এক অমোঘ নেতৃত্বকে চিরকাল মনে রেখেছি, শ্রদ্ধা করেছি। ১৫ আগস্ট সত্যিই মনটা ভারাক্রান্ত থাকে প্রতি বছর। তবে দেশজুড়ে তার মূর্তি (এটাকে নাকি ভাস্কর্য বলতে হয়!) কোনো দিন মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। মানতে পারিনি সবখানে তার নাম যুক্ত করা। মানতে পারিনি ব্যক্তিপূজার এই গভীর ও ব্যাপক তোড়জোড়, সেই ১৯৯৬ সাল থেকে যার শুরু।

তবু আজ যখন কেউ সেসব মূর্তি ভাঙছে, ম্যূরাল ধ্বংস করছে, ফলক থেকে নাম মুছে দিচ্ছে- আমার খারাপ লাগছে। যখন গণভবনে আর মহান জাতীয় সংসদে চলছিল ভাঙচুর, লুটপাট - আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। বিদেশি মিডিয়া যখন সেসব ছবি প্রচার করছে, লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে। অন্য সম্প্রদায়ের বসত-ভিটা-দোকান ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িক দাংগাকে যখন উস্কে দেওয়া হচ্ছে, তখন আমি বেদনায় বিদীর্ণ হয়ে পড়ছি। বিশেষ করে পাশের দেশে যখন বিকৃতভাবে আমাদের এই বিজয়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে, আমার অন্তরাত্মা জ্বলে যাচ্ছে।

আমি বিশ্বাস করি, আজকের জেনারেশন-জি তাই পারবে, আমরা যা পারিনি। আমাদের এত দেরি হলো মানব আর দানবের প্রভেদ বুঝতে? ওদের তো দেরি হয়নি! আমরা তো অনেক আগে থেকেই সিন্ডিকেটের কারসাজি, সরকারের সর্বস্তরে দুর্নীতি আর নেতাদের সীমাহীন আধিপত্যকে ঘৃণা করেছি। পদে পদে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুস দিতে দিতে আমি ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে হয়ে পড়ছিলাম বিপর্যস্ত। তবু কোনোদিন তো প্রতিবাদ করতে পারিনি...।

বিজ্ঞাপন

প্রসংগত, আমি জীবনে একবার মাত্র ভোট দিয়েছি, সেটাও ‘না-ভোট’। এরপরের তিন নির্বাচনে তো ভোট দিতেই যাইনি। গেলেও কি দিতে পারতাম? সেই ভোটাধিকার তো কবেই হারিয়েছিলাম। তারপরও প্রকাশ্যে এই দলের প্রতি বিষোদ্গার করিনি। সাহস পাইনি। জেন-জি এর এই সম্মিলিত দু:সাহসকে তাই জানাই লাল সালাম।

গত ৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথগ্রহণ করেছেন। প্রবীন ও নবীনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দেশের এক অভিনব অভিভাবক। তারা রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে, চাঁদাবাজি রুখে দিয়েছে, সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছে, নিত্য-পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছে - যা দেশবাসীকে অভিভূত করেছে। পুলিশ বাহিনী কাজে ফেরা অবধি তারা রাত জেগে মহল্লায় মহল্লায় টহল দিয়েছে। তথাকথিত ডাকাত ধরে সেনাবাহিনী/বিজিবি-র কাছে সমর্পণ করেছে।

নতুন এক বাংলাদেশ একটু একটু করে রূপ নিচ্ছে, যার নাম ‘বাংলাদেশ ২.০’। কিন্তু যখন দেখছি শাপলা চত্বরের নাম ‘শহীদি চত্বর’ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠি, দোকানে-দোকানে আরেকটি দলের নেতারা শুরু করেছে চাঁদাবাজি, হাওয়া ভবনের হোতা আজ ভালো মানুষটি সেজে দাঁড়াতে চাইছে নতুন বাংলাদেশের সরকার-প্রধান হবার তীব্র বাসনায়, তখন আবার বুক কেঁপে ওঠে। যখন দেখি গোপালগঞ্জে এখনও রামদা-লাঠি নিয়ে মিছিল হয়, আমি আবার হতাশ হয়ে যাই।

বিজ্ঞাপন

মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরো আন্দোলনটা একটা ছকে ফেলা ঘটনা প্রবাহ। একপক্ষ যখন চলেছে গতানুগতিক ক্ষমতার অন্ধ অহংকারকে পুঁজি করে (তাই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে), তৃতীয় পক্ষ তখন চৌকষভাবে একের পর এক দাবার চাল দিয়ে প্রতিপক্ষকে কিস্তিমাতের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে? সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের সুনিপুণ ভূমিকার জন্য। তবু মনে দ্বিধা। ‘বাংলাদেশ ২.০’ কী তবে সাময়িক সাফল্যের জন্য সৃষ্টি হলো?

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

তবে কী ভারতের দাস এবার পরিণত হবে পাকিস্তানের দাসে? নাকি চীন আর আমেরিকার রুটি-ভাগের কাড়াকাড়িতে বলির পাঁঠার মতো কাটবে আমাদের অনাগত বছরগুলো? তবে কী স্বৈরাচারের পতনের এই আন্দোলনে ছাত্ররা শুধুই দাবার গুটি? নেপথ্যে কি চাল চালছিল অন্যকোনো মাস্টার-মাইন্ড?

এক রক্ত পিপাসু ডাইনীর কবল থেকে সোনার এই রাজ্য কি চলে যাবে এক খল যুবরাজের দখলে? নাকি নতুন এক সূর্য উদিত হবে? বাংলাদেশ চিরতরে ঘুরে দাঁড়াবে শোষণ, দুর্নীতি আর সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে? সেই জবাব দেবে আমাদের পরের প্রজন্ম। শুভ প্রত্যাশায় বুক বেঁধে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আজ গোটা বাংলাদেশ।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com