গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদের ইতিহাস

ওমর ফারুক ফেরদৌস
ওমর ফারুক ফেরদৌস ওমর ফারুক ফেরদৌস , আলেম ও লেখক
প্রকাশিত: ১২:১২ পিএম, ১২ জুলাই ২০২৫
গাজার ওমরি মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

গাজার পুরনো শহরে অবস্থিত ‘মসজিদ আল-ওমরি আল-কাবির’ গাজার প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ মসজিদ। মসজিদটিকে ‘জামে গাজা আল-কাবীর’ অর্থাৎ গাজার বড় মসজিদও বলা হয়। ফিলিস্তিনে এটি তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ—বায়তুল মুকাদ্দাস ও আহমদ পাশা আল-জাজার মসজিদের পরই এর অবস্থান। মসজিদটির আয়তন প্রায় ৪,১০০ বর্গমিটার। এর প্রাঙ্গণের আয়তন ১,১৯০ বর্গমিটার। এখানে একসাথে ৩,০০০-এরও বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

ওমরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) খেলাফতকালে। পরবর্তীতে তার নামেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মসজিদ আল-ওমরি’। এর আগে এ জায়গায় ছিল গির্জা, আরও আগে ছিল প্যাগান মন্দির।

মন্দির থেকে গির্জায় রূপান্তর

প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এটি ছিল পৌত্তলিকদের অন্যতম বৃহৎ মন্দির। তখন গাজা ছিল ফিলিস্তিন ও শামের সর্বশেষ শহরগুলোর একটি। গাজায় তখন পৌত্তলিকদের আধিপত্য ছিল। সে সময় মন্দিরটি ছিল মজবুত দুর্গাকৃতির ভবন, যার আয়তন ছিল ৭০,০০০ বর্গমিটারের বেশি। আজ যেখানে মসজিদে ওমরির মিনারটি দাঁড়িয়ে, তখন সেখানে ছিল তাদের উপাস্য জিউসের মূর্তি। মন্দিরের এক প্রান্তে ছিল গাজা নগরীর প্রধান প্রবেশদ্বার।

গাজার খ্রিস্টানরা তখন গোপনে ধর্মচর্চা করত। পৌত্তলিকরা খৃষ্টানদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাতো। গাজার খৃষ্টানদের একজন পুরোহিত গাজা থেকে বিতাড়িত হয়ে রোমানদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে যান এবং তৎকালীন রোমান সম্রাট ও তার স্ত্রীর কাছে গাজার খ্রিস্টানদের দুরবস্থা তুলে ধরেন।

গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদের ইতিহাসউনিশ শতকে মসজিদে ওমরি। ছবি: উইকিপিডিয়া

তার আবেদনের প্রেক্ষিতে রোমান সেনাবাহিনী খ্রিষ্টীয় ৫ম শতকে গাজায় অভিযান চালায় এবং পৌত্তলিকরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। গাজায় পৌত্তলিক রাষ্ট্রের পতন ঘটে এবং খ্রিস্টধর্মকে গাজার সরকারি ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রোমানরা প্যাগানদের দেবতা জিউসের মূর্তি মাটির নিচে পুঁতে ফেলে এবং মন্দিরটিকে একটি গির্জায় রূপান্তরিত করে।

গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তর

৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর ইবুল খাত্তাবের (রা.) খেলাফতকালে আমর ইবন আসের (রা.) নেতৃত্বে গাজা যখন মুসলমানদের শাসনাধীনে আসে, তখন গাজার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারা শহরের সবচেয়ে বড় গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরের প্রস্তাব দেয়। এরপর এটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়।

১১৪৯ খৃষ্টাব্দে ক্রুসেডাররা যখন গাজা দখল করে, তখন তারা ওমরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে ‘সেন্ট জন গির্জা’ নির্মাণ করে। ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি ক্রুসেডারদের পরাজিত করার পর এটি আবার মসজিদে রূপান্তরিত হয়।

মামলুক ও উসমানীয়দের যুগে ওমরি মসজিদ

খ্রিষ্টীয় ১৩ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মসজিদটি প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। মামলুকদের শাসনামলে মসজিদটিকে সম্প্রসারণ করা হয় এবং এতে বিভিন্ন সংস্কার করা হয়। পরে মঙ্গোলদের আক্রমণে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক বছর পর মামলুকরা আবার এটি পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করে।

গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদের ইতিহাসওমরি মসজিদের মিনার। ছবি: উইকিপিডিয়া

মসজিদে ওমরির প্রথম মিনারটি মামলুক আমলেই নির্মিত হয়। তাতে যে শিলালিপি পাওয়া গেছে তাতে মিশরের মামলুক সুলতান নাসির কালাউন, কায়েতবে এবং আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাঈনের নাম রয়েছে, যারা ১৪ থেকে ১৬ শতকের শাসক ছিলেন। এ ছাড়া ১৬৬৩ সালে গাজার অটোমান গভর্নর মুসা পাশার নামও শিলালিপিতে পাওয়া যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বোমা বর্ষণে মসজিদের বড় অংশ ধ্বংস হয় এবং মিনারটি ভেঙে পড়ে। ১৯২৬ সালে মসজিদটি পুননির্মিত হয়।

গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদের ইতিহাসইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ওমরি মসজিদ

গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধে ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ইসরায়েলি বিমান হামলায় ওমরি মসজিদ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এর আগেও ২০১৪ সালে ইসরায়েলের আক্রমণে এই মসজিদের কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল যা পরবর্তীতে পুননির্মাণ করা হয়। কিন্তু এবার মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ওমরি মসজিদের পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের ৪৫% সম্পন্ন হয়েছে। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মসজিদটির পূর্ণ পুনরুদ্ধারে আরও ১৮-২৪ মাস সময় লাগবে।

ওএফএফ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।