তারাবিহ নামাজের ফজিলত ও তথ্যাদি
তারাবিহ বা কিয়ামুর রামাজান। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিরাট নিয়ামত। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হচ্ছে নামাজ। আর রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে তারাবিহ ও ই’তিকাফ।
তারাবিহ নামাজের যাবতীয় ফজিলত ও তথ্যাদি জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
তারাবিহ’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিমামণ্ডিত পবিত্র রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন, এর ফজিলত বর্ণনা করেছেন এবং তিনি নিজে ২৩, ২৫, ২৭ শে রমজান মোট তিন দিন জামায়াতের সঙ্গে তারাবিহ নামাজ আদায় করেছেন।
তারাবিহ নামাজ উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি রমজানের বাকী দিনগুলোতে জামায়াতের সহিত তারাবিহ নামাজ আদায় করেননি।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তারাবিহ নামাজ ফরয হওয়ার ভয় সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয়ে যায়। সুতরাং তারাবিহ নামাজ জামায়াতের সহিত আদায় করা বিদআ’ত হওয়ার বিষয়টি আসতেই পারে না। যেহেতু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জামায়াতের সহিত তারাবিহ পড়েছেন। বরং তারাবিহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত।
১৪ হিজরী সনে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এ সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করেছেন।
আভিধানিক অর্থে তারাবিহকে (নিই’মাতিল বিদাআ’তু হাজিহি) অর্থাৎ সুন্দর বিদাআ’ত বলেছেন। (ছালাতুত তারাবিহ : নাছিরুদ্দিন আলবানী)।
[এই বাক্য শরয়ীভাবে নয়; কারণ শরয়ীভাবে বিদাআ’ত সম্পূর্ণভাবে ভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনু মাজাহ)।
যার পরিনাম জাহান্নাম (সুনানে নাসাই)।]
তারাবিহ নামাজের রাকাআ’ত
তারাবিহ নামাজের রাকাআ’ত সম্পর্কে অনেক মতামত রয়েছে, সাধারণ অর্থে আমরা এই উপমহাদেশের অধিকাংশ লোক তারাবিহ নামাজ ২৬০ রাকাআ’ত পড়ে থাকেন। তবে অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দিনে তারাবিহর নামাজ ২০ রাকাআ’ত পড়েন।
কিন্তু সহিহ হাদিসে ১১ রাকাআ’তের কথা রয়েছে। তথাপিও পবিত্র মাক্কাতুল মুকাররামাহ এবং মাদীনাতুল মুনাওয়ারাহসহ পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ স্থানে তারাবিহ নামাজ ২০ রাকাআ’ত পড়ে থাকেন।
যেহেতু তারাবিহ নামাজ রমজানে পড়া হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে রমজানের সকল ইবাদত অন্য মাসের ইবাদতের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি ছওয়াব বা প্রতিদান পাওয়া যায়। সেহেতু রমজানে সব ইবাদতগুলো বেশি বেশি করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
তাছাড়া রমজান মাসে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে তারাবিহ নামাজ; তাই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে আধিক্য সংখ্যক (২০ রাকাআ’ত) তারাবিহ নামাজ আদায় করা উচিৎ। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার মতপর্থক্যে যাওয়া যাবে না।
তারাবিহ’র ফজিলত
তারাবিহর ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে-
হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবিহ ছালাতের ব্যাপারে লোকদের উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রাত্রিতে ঈমানের সঙ্গে ও ছাওয়াবের আশায় ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল (ছাগীরা) গুনাহ ক্ষমা করা হয়’। (বুখারী, মুসলিম, আবুদ দাউদ, নাসাঈ)
হযরত আমর বিন মুররাহ আল-জুহানী হতে বর্ণিত তিনি বলেন, কুযাআ’হ গোত্রের এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি যদি এই মর্মে সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া (ইবাদতের উপযুক্ত) কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করি, রমজান মাসের ছিয়াম পালন করি, তারাবিহ ছালাত আদায় করি ও যাকাত প্রদান করি, তাহলে আমার ব্যাপারে আপনার মতামত কি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যে ব্যক্তি এর উপর মৃত্যুবরণ করবে, সে সত্যবাদী ও শহীদদের মধ্যে গণ্য হবে। (ইবনে খুযায়মা, ইবনে হিব্বান, তারগীব)
জামাআতের সহিত তারাবিহ :
ফরয নামাজ ব্যতিত অন্য সকল নামাজ একাকী আদায় করা উত্তম। কিন্তু তারাবিহ নামাজ ব্যতিক্রম। তারাবিহ ছালাত জামাআতের সহিত আদায় করা শরীয়ত সম্মত। বরং তারাবিহ একাকী আদায় করার চেয়ে জামাআত বদ্ধভাবে আদায় করা উত্তম। কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তারাবিহর জামাআ’ত করেছেন এবং তার পবিত্র জবান মুবারকের বাণী দ্বারা উহার ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে রমজানের রোযা রাখলাম। তিনি প্রায় পুরো মাসটাই আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করেননি। শেষ পর্যন্ত যখন মাত্র সাত দিন অবশিষ্ট থাকল, তখন তিনি আমাদেরকে নিয়ে ছালাতে দাঁড়ালেন (২৩তম রাত); এমনকি রাতের এক-তৃতীয়াংশ ছালাতে অতিবাহিত হল। অতঃপর ষষ্ঠ রাতে তিনি আমাদেও নিয়ে ছালাতে দাঁড়ালেন না। অপর পঞ্চম রাতে তিনি আমাদেরকে নিয়ে ছালাতে দাঁড়ালেন (২৫তম রাত) এবং অর্ধরাত অতিবাহিত হল। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি যদি এ রাতের ছালাতকে আমাদের জন্য নফল করে দিতেন (তাহলে কতইনা ভাল হত!)। তিনি বললেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ইমামের সঙ্গে ছালাত শেষ করা পর্যন্ত ছালাত আদায় করবে, তখন তার জন্য পুরো রাতটাই ছালাত আদায় করা হিসাবে গণ্য হবে (অর্থাৎ পুরো রাত ছালাত আদায়ের নেকি তার জন্য লিপিবদ্ধ করা হবে)।
বর্ণনাকারী বলেন, আবার যখন চতুর্থ রাত হল, তিনি ছালাত আদায় করলেন না। অতঃপর যখন তৃতীয় রাত (২৭তম রাত) হল, তখন তিনি তার পরিবার-পরিজন, স্ত্রীগণ ও অন্যান্য লোকদের একত্রিত করে আমাদেরকে নিয়ে এত দীর্ঘ সময় ছালাত আদায় করলেন যে, আমরা ‘ফালাহ’ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা করলাম। হযরত জুবাইর বিন নুফাইর বলেন, আমি জিজ্ঞাস করলাম, ‘ফালাহ’ কি? তিনি (আবু যর) বলরেন, সাহরি। অপর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি আমাদের নিয়ে ছালাতে দাঁড়াননি। (তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইরওয়াউল গালীল)।
সুতরাং জামাআ’তের সহিত তারাবিহ আদায় মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিরাট নিআ’মত। এতে কোনো খারাবি ও অবৈধ হওয়ার কোনো বিষয় নাই।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তারাবিহ জামায়াত অব্যাহত না রাখার কারণ হচ্ছে-
রমযান মাসে উম্মতের উপর তারাবিহ নামাজ ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহাবাদের নিয়ে জামাআ’তে তারাবিহ আদায় করেননি। (কারণ যদি ফরয হয়েই যেত) তাহলে তারা তা পালন করা সম্ভব হত না। যেমনটি বুখারী, মুসলিমসহ অন্যান্য গ্রন্থে হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হদিসে এসেছে- আল্লাহ তাআলা শরীআ’তের পূর্ণতা দানের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের মাধ্যমে এই আশঙ্কা দূরীভূত হয়ে গেছে। এর ফলে তারাবিহ জামাআ’ত পরিত্যাগের কারণও দূরীভূত হয়ে গেছে এবং পূর্ববর্তী হুকুম তথা জামাআ’তে তারাবিহ ছালাত আদায় শরীআ’তসম্মত হওয়া বহাল রয়েছে। এ জন্য হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তারাবিহ জামাআ’তকে পুনর্জীবিত করেছিলেন। যেমনটি বুখারিসহ সহিহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে। (বুখারি, মুয়াত্তা মালেক, মসলিম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)
তারাবিহর কিরাআ’ত
রাতের ছালাত বা তারাবিহ বা তাহাজ্জুদে কিরাআ’তের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কোনো সীমা বা আয়াত সংখ্যা নির্ধারণ করে দেননি, কম বা বেশি করার মাধ্যমে যা অত্রিক্রম করা যাবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো প্রত্যেক রাকাআতে সুরা মুয্যাম্মিল পরিমাণ পড়তেন, যার আয়াত সংখ্যা ২০। আবার কখনো কখনো পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ পড়তেন। তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি এক রাতে একশ’ আয়াত পড়ার মাধ্যমে ছালাত আদায় করবে, গাফিলদের (উদাসীন) মধ্যে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হবে না। (আবু দাউদ, তাবরানী, দারেমি)।
অন্য আরেক হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি এক রাতে দুইশত আয়াত পড়ার মাধ্যমে ছালাত আদায় করবে, একনিষ্ঠ ও অনুগতদের মধ্যে তার মধ্যে তার নাম লিখা হবে। (দারেমি, হাকেম)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থ অবস্থায় এক রাতে সাতটি দীর্ঘ সুরা পড়েছিলেন। সুরাগুলো হল সুরা বাকারাহ, আলে ইমরান, নিসা, মাযেদা, আনআ’ম, আ’রাফ ও তাওবা। (আবু ইয়া’লা, হাকেম)
কত আয়াত তেলাওয়াত করবে এ ব্যাপারে আরো অনেক বর্ণনা রয়েছে, তবে সর্বোপরি কথা হচ্ছে, যদি মুছল্লি একাকী তারাবিহ ছালাত আদায় করে তাহলে তার ইচ্ছা অনুযায়ী কিরাআ’ত দীর্ঘ করবে। সে যতই কিরাআ’ত দীর্ঘ করবে ততই ভাল। আবার এমন দীর্ঘও করবেন না যাতে তার সাহরি খেতে ও ফজর নামাজ পড়তে অসুবিধা হয়।
তারাবিহর সময় :
এশার নামাজের পর থেকে ফজর পর্যন্ত রাতের ছালাতের সময়। এ মর্মে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য একটি ছালাতকে বৃদ্ধি করেছেন। তা হল বিতর। অতএব তোমরা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে উহা আদায় কর। তবে সম্ভব হলে শেষ রাতে রাতের নামাজ আদায় করা উত্তম। তিনি বলেন, শেষ রাতে জাগতে না পারার আশঙ্কা করলে সে যেন রাতের প্রথম অংশেই বিতর পড়ে নেয়। আর যে শেষ রাতে জাগতে আগ্রহী সে যেন শেষ রাতেই বিতর পড়ে। কেননা শেষ রাতের ছালাতে ফিরিশতাগণ উপস্থিত হন। আর এটাই সর্বোত্তম। (মুসরিম, মুসনাদে আহমদ, তাবরানী, তাহাবী ও সিলসিলা)
তারাবিহর পদ্ধতি :
প্রনিধানযোগ্য মত হচ্ছে তারাবিহ দুই দুই রাকাআ’ত করে নামাজ আদায় করা।
প্রত্যেক চার রাকাআ’ত নামাজ আদায়ের পর দুআ, তাওবা, ইসতেগফার করা এবং মোনাজাত করে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করা। (মোনাজাত নামাজ সম্পূর্ণ করার পরও করা যাবে; এটা আবশ্যক কোনো বিষয় নয়)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তারাবিহ নামাজ জামাআ’তের সহিত আদায় করার তাওফিক দান করুন।
জাগো নিউজ২৪ ডটকমের সঙ্গে থাকুন। রমজান সম্পর্কিত সুন্দর সুন্দর ইসলামী আলোচনা পড়ুন। কুরআন-হাদীস মোতাবেক আমলী জিন্দেগী যাপন করে রমজানের রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জন করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন।
একে/পিআর