আলোচনায় ছিল যাবজ্জীবন-আমৃত্যু দণ্ড, পাবজি-ফ্রি ফায়ার নিয়ে আদেশ

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২১ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১

করোনাভাইরাস মহামারিতে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। মহামারি রোধে ঘোষিত লকডাউনসহ নানা কারণে বিচার কার্যক্রমেও এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন বৈপ্লবিক না হলেও পদ্ধতিগত কিছু নতুনত্ব এসেছে। আইনি কাঠামোতেও লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া, যার মধ্যে ভার্চুয়াল আদালত ছিল অন্যতম।

তবে সশরীরে হোক কিংবা ভার্চুয়ালে, বিচার প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। রিট, শুনানি, রায় ঘোষণা হয়েছে নিয়ম মেনেই। বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি স্বত্ব, পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, পাবজি-ফ্রি ফায়ার বন্ধে নির্দেশ, খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে রিট, যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা নির্ধারণ, সালিশে বসে কিশোরীকে বিয়ে করা চেয়ারম্যানকে বরখাস্তের আদেশ স্থগিতসহ নানান কার্যক্রম ছিল আলোচনায়।

ঘটনাবহুল বিদায়ী বছরে হাইকোর্ট বিভাগের আলোচিত রিট, মামলা, শুনানি, রুল জারি ও রায় নিয়ে এ প্রতিবেদন।

বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির স্বত্ব
মুজিববর্ষে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’র কেনা তিনটি বই নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। মেধাস্বত্ব চুরি করে মোটা অঙ্কের অর্থে বিক্রির অভিযোগে ‘জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড’ ও ‘স্বাধীকা পাবলিশার্স’ প্রকাশনা সংস্থার মালিক নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট রিট করা হয়। রিটের শুনানি নিয়ে চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ছবির কোনো কপিরাইট (স্বত্ব) ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাবে না বলে রায় দেন হাইকোর্ট।

রায়ে আদালত বলেন, বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐতিহাসিক ছবির স্বত্ব কোনো ব্যক্তির নয়। এর স্বত্ব একমাত্র জনগণের এবং রাষ্ট্রের।

পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
ইতিহাস বিকৃতিরোধে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে গত ২ ডিসেম্বর রিট করা হয়। এ রিটের শুনানি নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কেন অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ১৩ ডিসেম্বর রুল জারি করেন হাইকোর্ট

পাবজি-ফ্রি ফায়ার বন্ধে নির্দেশ
অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ অনলাইনভিত্তিক ক্ষতিকর সব গেমিং অ্যাপ বন্ধে গত ১৬ আগস্ট নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতের এ নির্দেশনার পরপরই তা বন্ধের উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। একই সঙ্গে টিকটক, বিগো লাইভ, লাইকি বন্ধের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

তার আগে গত ২৪ জুন হাইকোর্টে ‘ল অ্যান্ড লাইফ’ ফাউন্ডেশনের পক্ষে গেম এবং অ্যাপগুলোর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনস্বার্থে রিট আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব ও মোহাম্মদ কাউছার রিট করেন।

পরে ২৫ আগস্ট জাতীয় সংসদের আলোচনায় অভিযোগ করা হয়, পাবজি-ফ্রি ফায়ার বন্ধ হয়নি। তখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানায়, ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো অনলাইন গেম বন্ধ (ব্লক) করার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। গেমগুলো পুরোপুরি ব্লক করতে কিছুটা সময় লাগবে।

খালেদার জন্মদিন নিয়ে রিট
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের দিন বা জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন যুবলীগ নেতা মামুনুর রশিদ। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি। রিটের শুনানি নিয়ে খালেদা জিয়ার জন্মদিন সংক্রান্ত তথ্য বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা দেন আদালত। গত ১৫ ডিসেম্বর বিভিন্ন দপ্তর থেকে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী খালেদা জিয়ার তিনটি জন্মদিন পাওয়া গেছে, তা হলো- ১৯৪৬ সালের ৮ মে, ১৫ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর। আদালত এ রিটের পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন জানুয়ারিতে।

যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা নির্ধারণ
যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ নিয়ে দীর্ঘ সময় অস্পষ্টতা ছিল। ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর এক রায়ে আপিল বিভাগ আদেশ দেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাভোগ করতে হবে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে যাবজ্জীবন সাজার বিষয়ে আদালতের রায়ে ‘আমৃত্যু’ শব্দটি উল্লেখ থাকলে তা আমৃত্যুই হবে। আর যাবজ্জীবন সাজার অর্থ হবে ৩০ বছরের কারাদণ্ড। চলতি বছরের ১৫ জুলাই এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। রায়ে বলা হয়, প্রাথমিক অর্থে যাবজ্জীবন কারাবাস মানে কোনো দণ্ডিতের বাকি জীবন। ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধির এ সংক্রান্ত বিধানগুলো একসঙ্গে পড়লে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের কারাবাস। তবে আদালত, ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাউকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলে সেই দণ্ডিত ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ ধারার সুবিধা পাবেন না।

আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকরের অভিযোগ
চুয়াডাঙ্গার একটি হত্যা মামলায় আপিল বিভাগে শুনানি ও নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে বলে এ বছর আলোচনায় এসেছে। ওই দুই আসামি হলেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙা উপজেলার দুল্লুকপুর গ্রামের মোকিম ও ঝড়ু।

আসামিপক্ষের আইনজীবীর দাবি, ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে করা আপিল আবেদনটি শুনানির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পর তারা স্বজনদের কাছ থেকে জানতে পারেন, চার বছর আগে ২০১৭ সালে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায় এমন খবর। পরে বিষয়টি নিয়ে চলে নানা গুঞ্জন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলাটি শুনানি হওয়ার আগে নয়। আপিল আবেদন করার পরে নিয়ম অনুযায়ী তা নিষ্পত্তি করেই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।

যদিও আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেছেন, ‘জেল আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আমি যে আপিল করেছি তার নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

কনডেম সেলে ১৯৮৭ কয়েদি
কনডেম সেলের বিষয়ে তথ্য চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির একটি আবেদন করেন। আদালত তাকে তথ্য দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক হাজার ৯৮৭ জন কয়েদি কনডেম সেলে বন্দি। তাদের মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৯৩৩ ও নারী ৫৪ জন।

সালিশে বসে কিশোরীকে বিয়ে, চেয়ারম্যানকে বরখাস্তের আদেশ স্থগিত
প্রেমিকের হাত ধরে ঘরছাড়া কিশোরীকে সালিশে বসে নিজেই বিয়ে করেন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদার (৬০)। গত ২৫ জুনের ওই বিয়ের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই বরখাস্তের আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, চেয়ারম্যানের বিষয়ে অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্তের কাজ চলতে বাধা থাকবে না। অবশ্য বিয়ের একদিন পর ওই কিশোরী শাহিন হাওলাদারকে তালাক দেয়।

মুরাদের অডিও-ভিডিও অপসারণ
মোবাইল ফোনে এক নায়িকার সঙ্গে অশালীন কথাবার্তা বলে এবং ফেসবুক লাইভে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে সম্প্রতি চরম বিতর্কের মুখে পড়েন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের পদও হারান মুরাদ। তার আপত্তিকর ওইসব মন্তব্য ও ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরাতে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। গত ৮ ডিসেম্বর বিটিআরসির পক্ষে ব্যারিস্টার খন্দকার রেজা-ই-রাকিব জানান, নির্দেশনা অনুযায়ী ৩৮৭টি অডিও-ভিডিও, ১৫টি ফেসবুক এবং ইউটিউব থেকে দুটি লিংক অপসারণ হয়েছে।

এফএইচ/এএএইচ/এইচএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।