নক্ষত্রের বিদায়


প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ২৩ মে ২০১৬

অজ্ঞতা আর শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়নকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিপীড়িত নির্যাতিত ও পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলিত, বিপন্ন অসহায় নারীদের পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক। বাবার হাত ধরেই মূলত সংবাদপত্র জগতে আবির্ভাব তাঁর।

উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে এর সম্পাদনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি শুধু একজন সাংবাদিকই নন লেখক গড়ার কারিগরও। অত্যন্ত নিষ্ঠা, দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্যপরায়ণ হয়ে ‘বেগম’ পত্রিকাকে উৎকর্ষের শীর্ষে নিয়ে যান তিনি।

দীর্ঘ ছয় দশক বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন নূরজাহান বেগম। নারী জাগরণে, নারী অধিকার আদায়ে নূরজাহান বেগম তাই একটি বিশিষ্ট নাম। তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারালো বাংলাদেশ।

বেগম নিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ হতো। মুসলমান পুরুষরাই যেখানে হিমশিম খাচ্ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতি এবং শিল্পচর্চায়। সেখানে নূরজাহান বেগমের অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, শিল্পবোধ এবং নিরলস কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে ‘বেগম’কে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে এতটুকু পিছপা হননি।

‘বেগম’ পত্রিকায় মূল বিষয়গুলোতে স্থান পায় নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মণীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী। ‘সওগাত’ পত্রিকা অফিসে বসে নূরজাহান বেগম ‘বেগম’ পত্রিকার কাজ করতেন।

নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ছিলেন ‘মাসিক সওগাত’ এবং ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং মা ফাতেমা খাতুন ছিলেন গৃহিনী।

দাদা আব্দুর রহমান বাংলা ভাষার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি পদ্য রচনা করে আসরে পুঁথির সুরে তা পাঠ করতেন। শুভংকরের অংকও তিনি ভালো জানতেন।

নূরজাহান বেগমের শৈশব কেটেছে গ্রামের বাড়িতে মা, মামা, দাদী, নানীর সঙ্গে। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন খুবই চঞ্চল। তাঁকে সামাল দিতে সবাইকে হিমশিম খেতে হতো। বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন থাকতেন কলকাতায় ১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়িতে। দোতলার একদিকে ছিল তাঁর সওগাত৬ পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল প্রেস ‘ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টার্স’ আর অন্যদিকে থাকা খাওয়ার ঘর।

জন্মের পর সবাই নূরজাহান বেগমকে আদর করে ডাকত নূরী। খেলার সাথীরা ডাকত মালেকা, চাচীরা ডাকতেন নুরুননেছা। স্কুলে ভর্তি করার সময় বাবা তাঁর নাম রাখেন নুরুন্নাহার।

গ্রামে থাকাবস্থায় নূরী ছুটে বেড়াত গ্রামের মাঠে ঘাটে, পুকুর নদী খালের পাড়ে। ছোট বেলায় চঞ্চল প্রকৃতির নূরজাহান বেগমের খালে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। দুর্ঘটনার খবরে আত্মীয়স্বজনের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্ত্রী ও কন্যাকে ১৯২৯ সালে কলকাতায় নিয়ে যান।

১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে কলকাতার সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য তৈরি করতে মনস্থ হলেন। বাড়ির নিচতলার এক ইংরেজ দম্পতির দুটি সন্তান লডেন ও টিটুর সঙ্গে সখ্যতা। ইংরেজিতে কথা বলার প্রথম পাঠটা ওদের সাথেই। ওই বাড়িতেই প্রথম দেখা কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। নজরুল যখন লেখায় গভীর মগ্ন তখন অনেক সময় মা নুরীর হাত দিয়ে চা পাঠিয়ে দিতেন।

ওই বাড়িতে কবি সাহিত্যিকদের নিয়মিত আসর বসতো। কবি খান মঈনুদ্দীন, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল ফজল, ওয়াজেদ আলী, আবুল মনসুর আহমদ, এস ওয়াজেদ আলী, বার এটল ও তাঁর কন্যা ‘মিরর’ পত্রিকার সম্পাদক।

নূরজাহান বেগমের লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি হয় মায়ের হাতে। নতুন স্লেটের ওপর পেন্সিল দিয়ে লিখলেন অ আ ই ঈ। একই দিনে বাবাও তাঁকে আরবি পড়ার হাতেখড়ি দিলেন। শেখালেন আলিফ বা তা সা। সেই সঙ্গে ইংরেজি এ বি সি ডি।

তেমন পড়তে না পারলেরও আগ্রহ ভরে বাবার আনা পত্রপত্রিকাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের মজার মজার ছবি, প্রজাপতি, ফুল আর নানা ধরণের জীবজন্তুর ছবির দেখে পত্রপত্রিকা ফাইলিং করা শিখে ফেলেন। শিশু বয়সেই নূরী বাবা নাসিরউদ্দীনের কাছে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ নেয়।
 
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়াশুনা করেন।

তিনি ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর আই.এ. ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। তাঁর আই.এ.-তে পড়ার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল। এসময় তাঁর সহপাঠীরা মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করেন। তিনি কলেজে কবিতা আবৃত্তি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে, অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

লেডি ব্রেবোর্ন থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাস করে বি.এ.-তে ভর্তি হন। তাঁর বিষয় ছিল Ethics, Philosophy, History তিনি ১৯৪৬ সালে কৃতিত্ব্বের সঙ্গে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হবার একবছর আগে ১৯৪৫ সালে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য সওগাত পত্রিকা অফিসে বসতে শুরু করেন।

১৯২৭ সালে মাসিক সওগাতে ‘জানানা মহল’ নামে প্রথম মহিলাদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। মেয়েদের এগিয়ে না আসায় তিনি মেয়েদের ছবি দিয়ে ১৯২৯ সালে মহিলা সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সওগাত মহিলা সংখ্যা বছরে মাত্র একটা করে প্রকাশ করা হয়।

বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে। আলোচনার ভিত্তিতে ‘বেগম’ এর প্রচ্ছদে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি ছাপা হয়। ‘বেগম’ এর প্রধান সম্পাদক বেগম সুফিয়া কামাল হলেও নূরজাহান বেগমই এর দেখাশুনা করতেন।

বেগম সুফিয়া কামাল মাঝে মধ্যে ‘বেগম’ পত্রিকা অফিসে এসে দু-একটা লেখা সংগ্রহ করে দিয়ে যেতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিন্দু লেখিকাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নূরজাহান বেগম বিভিন্ন ইংরেজি পত্র-পত্রিকা থেকে প্রতিবেদন অনুবাদ করতেন।

লেখিকার সংখ্যা কম, কবিতা নেই বললেই চলে, ছোট গল্প, উপন্যাস তো নেইই। এদিকে পত্রিকায় মহিলাদের ছবি তোলা এবং ছাপাতেও অনেক ঝামেলা। মহিলা ফটোগ্রাফার নেই। এভাবেই নানা অসুবিধা প্রতিকূলতার মাঝে তিনি কলকাতা থেকে দীর্ঘ তিন বছর ‘বেগম’ প্রকাশ করেন।

১৯৪৭ সালে বেগম সুফিয়া কামাল কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ ঢাকায় চলে আসার পর থেকে নূরজাহান বেগম ‘বেগমের’ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় প্রথম ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৯ সালে ‘বিশ্ব নবী সংখ্যা বেগম’ প্রকাশ করেন।

১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ‘বেগম’ পত্রিকার বয়স তখন মাত্র তিন বছর ছয় মাস। বুড়িগঙ্গার কাছে লয়াল স্ট্রিটের প্রেস। ৩৮ নং শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতেই ‘বেগম’-এর কাজকর্ম দেখাশোনা শুরু করেন তিনি। ‘বেগম’ পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয় সেখানেই। অনুষ্ঠানে বহু কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের সমাগম ঘটে। বাবার সঙ্গে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে আনতেন।

নূরজাহান বেগম নানা প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে ধীরে ‘বেগম’ পত্রিকা নিয়ে অগ্রসর হন। এসময় সাহিত্য কর্মে মুসলমান নারী সমাজও অংশগ্রহণ শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে সারা বাংলাদেশে ‘বেগম’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মহিলা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। নূরজাহান বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা, কর্মনিষ্ঠা এবং মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বেগম’ দ্রুত মহিলাদের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ‘বেগম’-এ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধের পাশাপাশি রান্না, সেলাই, সৌন্দর্য চর্চা, শিশু বিভাগ প্রভৃতি প্রকাশিত হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরাও ‘বেগম’ পত্রিকার লেখকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ছবিসহ লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা থাকায় ‘ঈদ সংখ্যা বেগম’-এ লেখিকাদের অংশগ্রহণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়।

১৯৫৪ সালে প্রখ্যাত মার্কিন মহিলা সাংবাদিক সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মিসেস আইদা আলসেথ ঢাকায় আসেন। একদিন তিনি সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পরিদর্শনে আসেন। তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের অনেক মাসিক পত্রিকা বের হয় কিন্তু মহিলাদের জন্য কোনো সাপ্তাহিক সাময়িকী এখনো প্রকাশিত হয়নি।’

‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমেই রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় নূরজাহান বেগমের। এরপর ১৯৫২ সালে রোকনুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপে তিনি সবসময় বাবা ও স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। বিয়ের বছর তিনেক পর বড় কন্যা মেয়ে নাসরীন খান শাখীর জন্ম। ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন খান মিতি। স্বামী, সন্তান, জামাতা, নাতি-নাতনি, বাবা-মাকে নিয়ে নূরজাহান বেগমের দিনগুলো সুখেই কাটছিল। ১৯৯৪ সালের ২১ মে বাবা  নাসিরউদ্দীন ও ১৯৯৯ সালে মা মারা যান। ১৯৯৯ সালের স্বামী রোকনুজ্জামান খান মারা যান। এরপর থেকে নূরজাহান বেগম একাকী জীবন যাপন করছিলেন।

সব শেষে সোমবার বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার এই উজ্জ্বল নক্ষত্র স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

বাদ জোহর পীর সাহেবের মসজিদে প্রথম নামাজে জানাজা শেষে গুলশান ১ জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। সবশেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

জেইউ/এসএইচএস/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।