চোখের পলকে তাজা প্রাণগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে


প্রকাশিত: ০৭:৩০ পিএম, ২৪ মার্চ ২০১৭

‘ঘুট ঘুটে অন্ধকার। এরই মধ্যে আচমকা আলো ফুটতে শুরু করে। আঁধারের বুক চিরে আসা আলোগুলো কালো কালো ছোপ ফেলে নিভে যাচ্ছে। চোখের পলকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে প্রাণহীন দেহ।’

এভাবেই ২৫ মার্চ কালরাতের বর্ণনা দেন ওই সময় ঢাকার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক খসরু স্বাধীনতা উত্তরকালে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কামরুল আলম খান খসরু।

সেই কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছিলেন খসরু। সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার মনে অজানা এক আশঙ্কা কাজ করছিল। তৎকালীন ইকবাল হল, মানে বর্তমান জহুরুল হক হলে বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন আমরা দেড়-দুইশ জন ছিলাম। আমি সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলাম, তোমরা এখানে থেকো না। কারণ যেকোন সময় হামলা হতে পারে। হলের দারোয়ান শামসুকে বললাম, তুমিও থেকো না। পাকিস্তানি আর্মির গ্রেনেড হামলায় তার মৃত্যু হয়। শাহ্ চিশতি হেলালুর রহমানকেও চলে যেতে বলি, তাকেও মেরে ফেলা হয়। কথা বলার মাঝখানে অনেকেই চলে যায়। কেউ কেউ তখনও হলে অবস্থান করছিল। তারা বলছিল, আরে নাহ্ কি আর হইবো?

খসরু বলেন, এখন যেখানে ইকবাল হলের নতুন গেইট করা হয়েছে তখন সেখানে জঙ্গল ছিল। রাত ঠিক সাড়ে ১১টার সময় সেখান থেকে পাকিস্তানি আর্মি বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করে। দেখলাম, চোখের পলকে তাজা প্রাণগুলো লাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না ঠিক সে মুহূর্তে কী করা উচিত? একবার ভেবেছিলাম পাশের গোয়াল ঘরটায় গোবরের ভেতর ঢুকে যাই। কিন্তু পর মুহূর্তে ভাবলাম, পোকা-মাকড় পেয়ে বসলে আরেক বিপদ হবে। নিরুপায় হয়ে আমি ইকবাল হলের তৎকালীন ভিপি জিনায়েত আলীকে বললাম, জিনায়েত ভাই খবরদার আমাকে ফলো করা ছাড়া অন্য কোথাও যাবেন না। আপনি আমার সাথে আসুন।

আমি জিনায়েত ভাইকে নিয়ে কোনো রকম গ্যারেজের উপর উঠলাম। আমাদের দেখাদেখি আরও চার-পাঁচজন উঠলো। আমি সবাইকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বললাম। দেখি একের পর এক ট্রেজার লাইট আকাশে ছোড়া হচ্ছে। আর বৃষ্টির মতো গুলি চলছে। একদিকে নিজেকে প্রাণপণ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা; অন্যদিকে মৃত্যু যেন প্রতি মুহূর্তে কড়া নাড়ছে। এ দোলাচলের মধ্যেই ভেবে দেখলাম, সকাল হলেই আমাকে গ্রেফতার করা হবে। এমনিতেই পাকিস্তানি আর্মি আমাকে উন্মাদের মতো খুঁজছে।

তিনি বলেন, হঠাৎ মাথায় এলো ট্যাংকির উপর বেশিক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যাব। আমি জিনায়েত ভাইকে ইশারা দিয়ে নেমে আসলাম। জিনায়েত ভাইও পেছন পেছন নেমে এলো। বললাম, আপনি কি আমার সাথে যেতে পারবেন? অনেক পথ হাঁটতে হবে। তিনি বললেন, না আমি অত দূর হাঁটতে পারবো না। তিনি তার পরিচিত এক প্রফেসরের বাসায় থেকে গেলেন। আর আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে অবস্থিত মাজারের সামনে দিয়ে এগুতেই দেখি, পাকিস্তানি আর্মি উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে রেখেছে। ফলে ওদিক দিয়ে বের হতে পারলাম না। ফিরে এসে উদয়ন স্কুলের সামনের তেঁতুল গাছটায় উঠলাম। চারপাশ অন্ধকার থাকলেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। অবশ্য এ এলাকা আমরাই অন্ধকার করে রাখতাম। সারা গায়ে তেল মেখে যখন আমরা মিছিল বের করতাম, তখন আমার টু-টু রাইফেল দিয়ে গুলি করে রাস্তার সবগুলো লাইট ভেঙে ফেলতাম; যাতে প্রয়োজনের সময় আত্মরক্ষার পথ খোলা থাকে।

কিছুক্ষণ পর গাছ থেকে নেমে এস এম হলের সামনে গেলাম। দেখি দেয়ালগুলো ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়েছে। আমি পেছনের দেয়াল টপকে ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেলের ভেতরে প্রবেশ করে একটু বিশ্রাম নিলাম। এরপর গেলাম মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর দিয়ে নজরুল হলের সামনে। দেখি একটা আর্মির গাড়ি যাচ্ছে। আমি হলের বিশ ইঞ্চি দেয়ালটার উপর দাঁড়িয়ে কোনোমতে একটা গুলি ছুড়ে পুরনো ঢাকার দিকে দৌড় দেই। পরবর্তীতে সেখানে যখন এসেছিলাম দেখি, ওই স্থানে এতো গুলি করা হয়েছে যে একটা বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

পুরনো ঢাকায় গিয়ে দেখি, আর্মিতে গোটা এলাকা পরিপূর্ণ। অগত্যা আবার নীলক্ষেত এলাকায় ফিরে আসি। সেখান থেকে সোনারগাঁ হোটেলের সামনে পৌঁছাই। তখন ওই এলাকাটা বিল ছিল। একটা নৌকা আর একজন মাঝিকে নিয়ে এফডিসি (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন) ও রামপুরা টেলিভিশন অফিসের পেছন দিয়ে মুগদায় পৌঁছাই। সেখানে আমার গ্রুপের ছেলে বাবুলের বাসায় উঠি। ওই সময় আমার বাসার পরিস্থিতি জানার খু্ব ইচ্ছা হলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবারও বের হই। নৌকা দিয়ে ধোলাই খাল হয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে আমার এলাকার কাছে পৌঁছাই। অর্থাৎ নিজ এলাকায় আসতে আসতে ২৭ মার্চ হয়ে যায়।

এত ঝড়ের মধ্যে একটু স্বস্তি পেলাম। কারণ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এ সুযোগে আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছাই। তখন ওই এলাকা পুরোটাই জঙ্গল ছিল। আমার বাসাটা ছিল আজিমপুর গোরস্থানের খুবই কাছে। বাসায় কাছে গিয়ে দেখি ছাদের এক পাশের দেয়াল ভেঙে গেছে। ২৫ মার্চ রাতে আমার বাসায় শেল মারা হয়েছিল। এছাড়া দেয়ালে অসংখ্য গুলির দাগ। বাসায় ঢুকে দেখি সবাই আতঙ্কে আছে। আমি সবাইকে তৈরি হতে বললাম। চিন্তা ছিল, আব্বা-আম্মাসহ সবাইকে ওয়ারীতে আমার নানী বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু তুলকালাম পরিস্থিতির মধ্যে যাব কিভাবে? বাসা থেকে বের হয়ে নীলক্ষেত পেট্রোল পাম্পের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি হাজার হাজার মানুষ দিক-বিদিক ছুটছে।

একজন অবাঙালিকে সাইকেলে চড়ে আসতে দেখলাম। বললাম, ‘ঠ্যারো। কিধার জাতাহে। কাহা সে আয়া?’ সে বলে, ‘মোহাম্মদপুর সে আয়া।’ আমি বললাম, ‘এক মিনিট কে লিয়ে তুমহারা সাইকেল দো না।’ সে না করতেই কষে একটা থাপ্পড় মারি। সে মাটিতে পড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইকেল ছোটালাম। একেবারে সোজা ইকবাল হলে পৌঁছলাম।
হলে পৌঁছে দেখি অনেকগুলো লাশ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে চিশতি হেলালুর রহমান, শামসুল্লাহসহ অনেকে রয়েছে। রুমের কাছে গিয়ে দেখি সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। আমি একটা বানর পালতাম। সেও মরে পড়ে আছে। খাকি ড্রেস দেখলেই সে ছুটে আসতো।

এইউএ/এমএআর/আরএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।