করোনা মোকাবেলায় সমন্বয়হীনতা বড় উদ্বেগের কারণ
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষক। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী প্রধান ও বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলাপচারিতায় করোনার ভয়াবহতা মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মতামত ব্যক্ত করেন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের উপায় নিয়েও। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি থাকছে আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : করোনায় থমকে যাচ্ছে বিশ্ব। আক্রান্ত বাংলাদেশও। সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভাব ইতোমধ্যেই তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি আপনি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : অপ্রস্তুত থেকে অনেক দেশই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশকেও ঠিক অপ্রস্তুত থেকেই করোনা মহামারিকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা ছিল। কিন্তু আমাদের অভ্যাস হচ্ছে, দূরবর্তী কোনো ঘটনাকে গুরুত্ব না দেয়া। ঠিক তাই হয়েছে।
তবে মানুষকে ঘরমুখি করে চলাফেরার ওপর কিছুটা বাধা-নিষেধ করা হয়েছে, যা অত্যন্ত জরুরি ছিল। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আপাতত সামাজিক এই দূরত্ব কার্যকর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্য দেশও তাই করেছে।
জাগো নিউজ : আপনি চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন। কিন্তু অসঙ্গতিও আছে। ঢাকার মতো জায়গায় করোনাকালে উপ-নির্বাচন দেখলাম। এমন অসঙ্গতি অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : করোনা মোকাবেলায় মনোযোগ এবং প্রস্তুতির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে এবং বিভিন্ন মহল থেকে করোনা নিয়ে যে তথ্য আসছে, তা ঠিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়নি।
করানো পরিস্থিতির প্রাথমিক স্তর শেষ করে এসেছি মনোযোগ ছাড়াই। এখন পরের ধাপ। চলাফেরায় বিধি-নিষেধ বা এক প্রকার লকডাউন চলছে। অন্যরা এটি অনেক আগেই করেছে। আমরা করলাম পরে। তার মানে গুরুত্ব উপলব্ধির ঘাটতিটা এখনো রয়ে গেছে।
জাগো নিউজ : করোনা উপসর্গ নিয়ে মরছেন অনেকেই। বলা হয়ে থাকে, আক্রান্ত বা মৃত্যুর খবর নিয়েও ধূম্রজাল আছে। গুরুত্বের উপলব্ধির ঘাটতি থেকেই সরকারের এমন নীতির প্রকাশ?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : শুরু থেকেই আমরা মনোযোগের ঘাটতি দেখে আসছি। করোনা সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে জনগণ, সামাজিক শক্তি, সরকার, রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে একত্র হয়ে কাজ করা জরুরি। যারাই একত্র হয়ে কাজ করেছে, তারাই করোনা মোকাবেলায় আপাতত সফল হয়েছে। কোথাও রাষ্ট্র নেতৃত্ব দিয়েছে, কোথাও ব্যক্তি বা সামাজিক শক্তিগুলো নেতৃত্ব দিয়েছে। আস্থার ঘাটতিটা এখনো তীব্র বাংলাদেশে।
আংশিক তথ্য দিয়ে আসলে পূর্ণ আস্থা মেলে না। আপনি টেস্ট করছেন কম। ফলাফলও মিলছে কম। মাঠ পর্যায়ের মৃত্যু নিয়ে নানা আলোচনা আছে।
এরপরও আমি মনে করছি, মাঠ পর্যায়ে যে মৃত্যু হচ্ছে, তা সীমিত আকারেই। সরকারের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল থাকলেও আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংখ্যাটা ঠিক বিপর্যয়ের দিকে যায়নি এখনো।
জাগো নিউজ : তার মানে করোনা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে বলে মনে করছেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : নানা কারণেই করোনা বাংলাদেশে এখনো নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে। এর মধ্যে অন্তত সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
সরকার এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেকটাই আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে। আমাদের সামর্থ্য কম। হয়তো এ কারণেই পরীক্ষা কম হচ্ছে, সঠিক সেবা মিলছে না। কিন্তু সেটি স্বীকার করেও জন-আস্থা বাড়ানো সম্ভব। সবাইকে নিয়ে করা সম্ভব। নানামুখি উদ্যোগ আছে। কিন্তু কার্যকর উদ্যোগের জন্য আরও বিশ্বাস-আস্থা দরকার।
একটি মাত্র ল্যাব ছিল। এখন আরও বাড়ানো হচ্ছে। এটি আরও আগে করা সম্ভব হতো। প্রাইভেট সেক্টরকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে উদ্যোগ ছিল না। নিয়ন্ত্রণে রেখেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো সম্ভব। কিন্ত এক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা কাজ করেছে।
জাগো নিউজ : সরকারের দেয়া তথ্যে ঘাটতি এবং উদ্যোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব অন্তরায় কি-না?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : অসম্পূর্ণ বা লুকোচুরির তথ্য দিয়ে আপনি কোনো কিছুরই ভালো সমাধান দিতে পারবেন না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে মানুষ সামগ্রিক একটি চিত্র দেখতে চায়। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার তাহলে কিন্তু সমাধানের পথটা এমনিতেই বেরিয়ে আসবে। খণ্ডিত চিত্র থেকে মানুষ আসলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো ভরসা পায় না।
ঢাকা শহর অনেকটাই লকডাউনের মতো আছে। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে কী ঘটছে, তা নিয়ে কিন্তু নানা প্রশ্ন আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক অসঙ্গতিই উঠে আসছে। সচেতনতা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা আছে।
মসজিদগুলোতে জামাত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মসজিদে গিয়ে নামাজ না পড়লে ধর্মের সঙ্গে কোনো বিরোধ হতে পারে না, তা বোঝানোর ব্যাপার আছে। এটি বোঝানো সম্ভব হয়নি। ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হচ্ছে, ‘তোমরা দায়িত্বশীল হবে।’ এটি ধর্মেরই একটি অনুশাসন। অথচ এখানে সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে তাগাদায় ঘাটতি রয়েছে।
জাগো নিউজ : এই অবস্থায় বাংলাদেশে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে? কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি-না?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশে আসলে কী ঘটবে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। গণকের পক্ষে বলা সম্ভব হয়তো।
তবে আমরা বুঝতে পারছি, করানো নিয়ে সরকারের দেয়া তথ্য বহুলাংশেই অসম্পূর্ণ। অথবা আংশিক। এটিই সরকারও হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে স্বীকার করবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা আক্রান্তদের ব্যাপারে আর কীভাবে ধারণা করা যেতে পারে। পরীক্ষা তো সব জায়গায় হচ্ছে না। তাহলে জ্বর, সর্দি, কাশির উপসর্গ নিয়ে মানুষ মরছে কি-না, সে ব্যাপারে ধারণা রাখা। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে প্রক্সি ইন্ডিকেটর। অর্থাৎ বিকল্প উপায়ে তথ্য সংগ্রহ করা।
এক্ষেত্রে বেসরকারি সংগঠন বা সামাজিক শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রক্সি ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে মাঠের চিত্র তুলে আনা যায়। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশ আসলে কোথায় আছে বা কোথায় যাচ্ছে।
এর বাইরে আরেকটি বিষয় আমি সংযুক্ত করব এখানে। যারা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত তাদের মনোবলের ঘাটতি আছে বলে মনে করি।
দুটি কারণে এই ঘাটতি। প্রথমত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মনোবল চাঙ্গা করার একটি বিষয় রয়ে গেছে। নির্দেশ দিলেই কাজ হবে, এটি মনে করি না। জীবনবাজি রেখে তাদের কাজ করতে হয়। অনেকে কাজ করছেনও হয়তো। এনজিও কর্মীরা উদ্বুদ্ধ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীদের।
কিন্তু সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা সময়ের দাবি। এটি করতে পারলে মাঠ পর্যায়ের চিত্র এবং বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে, তার একটি চিত্র সহজেই উঠে আসবে। অথচ এখানে বড় একটি ঘাটতি রয়ে গেছে।
জাগো নিউজ : এই ঘাটতি পূরণে আপনার কী পরামর্শ?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান : ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা করলে হবে না। সামগ্রিক একটি বিপর্যয়ের মুখে আমরা। সরকারের বাইরেও রাষ্ট্রের বহু সংগঠন, শক্তি আছে। এমন কী বহুরাজনৈতিক শক্তির ওপরেও রাষ্ট্রের ভিত্তি।
এই মহাবিপর্যয় রুখতে হলে যৌথ উদ্যোগ জরুরি। যৌথ উদ্যোগ নিতে পারলেই নৈতিক বোধটা আরও জাগ্রত হবে। এটি করতে পারলে স্বাস্থ্যকর্মীরা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আরও উৎসাহিত হবেন।
স্বাস্থ্যকর্মীদের নৈতিক বুঝটা দেয়া জরুরি। একইভাবে কর্তৃত্ববাদী নয়, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ জরুরি। আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না।
করোনা কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে তার উত্তর আমাদের কাছে জানা নেই। কিন্তু নৈতিক জায়গা থেকে বিশ্বাসযোগ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে সবাই সমাধানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনেক দেশে কিন্তু সেভাবেই হচ্ছে।
এএসএস/এইচএ/পিআর