প্রধানমন্ত্রীর অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন সময়ের দাবি
রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহযোগী (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ)। সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। করোনাকালীন পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। প্রশাসনের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন।
করোনা-পরবর্তী সময়ে নতুন এক পৃথিবী সামনে আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব। বিপর্যস্ত বাংলাদেশও। আপনি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘসময়। করোনা মোকাবিলা কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
ওয়ালিউর রহমান : করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীতে একটি বড় মহামারিতে পরিণত হয়েছে। এর আগেও পৃথিবীতে অনেক মহামারি এসেছে। আজ থেকে শত বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসজনিত রোগে ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। এই শত বছরে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক সফলতা এসেছে। যদিও করোনার ধরন একটু ভিন্ন, আশা করি করোনাভাইরাস হয়তো অত ভয়াভহ হবে না।
অগ্রগতির এই যাত্রায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বিখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট বাংলাদেশ নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সম্প্রতি বলেছে, ‘উন্নয়নশীল প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে এখন নবম অবস্থানে।’ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশও বাংলাদেশের পেছনে অবস্থান করছে। গত এক দশকে উন্নয়ন প্রশ্নে যে বিপ্লব ঘটেছে, তারই মূল্যায়ন এটি। এর জন্য মূলত, সব প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় করোনা মোকাবিলায়ও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। অন্তত করোনার মৃত্যুর হার নিয়ে এমনটি উল্লেখ করা যেতেই পারে।
জাগো নিউজ : আপনি অগ্রযাত্রার কথা বলছেন। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনার কথাও আছে। এক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ?
ওয়ালিউর রহমান : প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা বা তাগিদ দেয়া হয় মাঠপর্যায়ে সেগুলোর বাস্তবায়নে কিছুটা অসংগতি হচ্ছে। সেগুলো ঠিক করতে আমার মতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন এখন সময়ের দাবি।
জাগো নিউজ : জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাজ কী হবে?
ওয়ালিউর রহমান : জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে দেশের আনাচে-কানাচের সবকিছু তদারকি করবে। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করবে।
জাগো নিউজ : আমলারা তো আছেন। জেলা-উপজেলা প্রশাসনও আছে…
ওয়ালিউর রহমান : ব্যুরোক্রেসি দিয়ে আসলে সব কাজ হয় না। আমলাতন্ত্র সব দেশেই আছে। এতদসত্ত্বেও অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলও আছে। কারণ প্রশাসন দিয়ে সব কাজ হয় না।
চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অসংগতি বা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন রোধের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কাউন্সিল থাকা প্রয়োজন।
জাগো নিউজ : বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই সরকারি আমলারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। এরপরও কেন অসংগতি বা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করতে হবে? কেন আমলাদের ওপর এই অনাস্থা?
ওয়ালিউর রহমান : ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে ভারত-শ্রীলংকা-নেপালের মতো দেশেও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো যথাযথ পালন হচ্ছে কি-না, তা এই কাউন্সিলের জনবল যাচাই করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তার বিবরণ দেবেন। প্রধানমন্ত্রী ফের নতুন করে নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ পাবেন।
জাগো নিউজ : প্রশাসনের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার তাগিদ থেকেই কি আপনার এই প্রস্তাবনা?
ওয়ালিউর রহমান : অনেকটা তা-ই এবং সমন্বয় তৈরি করা অতি-জরুরি। জাতীয় কাউন্সিল কেন গঠন করতে হবে, কীভাবে করা সম্ভব এবং কাজ কী হবে, তা নিয়ে আমাদের বিস্তর গবেষণা রয়েছে। আমরা প্রকাশনা আকারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা হস্তান্তর করেছি। এখন শুধু প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপার।
জাগো নিউজ : এই জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল কাদের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে?
ওয়ালিউর রহমান : অনেক দেশের উদাহরণ আছে আমাদের সামনে। পাশের দেশ ভারতে এর গঠনপ্রক্রিয়া আছে। মূলত প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
এই কাউন্সিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে। স্বাস্থ্য খাতের কোনো বিষয় নিয়ে তখন আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ওপর প্রধানমন্ত্রীকে নির্ভর করতে হবে না। কাউন্সিল যে পরামর্শ দেবে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী।
জাগো নিউজ : আপনি অন্য দেশের উদাহরণ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রধানও তিনি। এমন শক্তিধর থাকার পরও দুর্নীতি, অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ কাউন্সিল গঠন করলেই কি সমাধান?
ওয়ালিউর রহমান : একজন সরকারি কর্মকর্তা তার দায়িত্ব জানেন। কিন্তু অনেক কারণেই তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না, বা সম্ভব হয় না। এই কাউন্সিলের কাজ তাদেরও সহায়তা করা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি নির্দেশ ফলো করে কাজ হচ্ছে কি-না, তা নিয়েই প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। অন্য দেশও আমাদের মতো নানা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে। সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। তারপরই হয়তো জাতীয় কাউন্সিল গঠন করতে হয়েছে।
জাগো নিউজ : করোনাকালীন বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি-না?
ওয়ালিউর রহমান : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীকে সাজাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হলো। ওয়াশিংটন কনসেনসাস থেকে এসব সংস্থার গঠন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেগুলো অনেকটা ব্যর্থতার পরিচয়ও দিয়েছে।
করোনার দুঃসময়ের পর পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না। মানুষের সব পরিকল্পায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। সে পরিবর্তন কেমন হবে, তা হয়তো এখনই বলার সময় আসেনি। আমরাও গবেষণা করছি। হয়তো উপযুক্ত সময়ে আমরাও আমাদের গবেষণার ফল সামনে আনতে পারব।
জাগো নিউজ : সাধারণ মানুষ তথা শ্রমজীবী মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে কী বলা যায়?
ওয়ালিউর রহমান : প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, তা আমরা তার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা থেকে উপলব্ধি করতে পারি। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য শুরুতেই প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কৃষকের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা প্রণোদনার আওতায় আসছেন। ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে। আমাদের পক্ষ থেকেও মূল্যায়ন করে দেখেছি, বাস্তবায়নের বিষয়টি খুব পরিষ্কার নয়।
বাস্তবায়ন নিয়ে যদি আমরা শতভাগ সফল হতে পারতাম, তাহলে অবশ্যই সাধারণ মানুষকে নিয়ে আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।
আগামী পৃথিবীর সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হবে এশিয়া। বিশেষ করে অর্থনীতির জন্য। যে কারণে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা আরও তীব্র করে তুলবে। আমাদের এই বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। সমাজ, অর্থনীতি এগিয়ে নিতে গেলে আমাদের পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার।
এএসএস/এমএআর/পিআর