‘তিন বিষয়ে’ সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না ট্রাইব্যুনাল

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

অডিও শুনুন

বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে দীর্ঘ পাঁচ মাস ২২ দিন বন্ধ ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রম। যদিও এ সময় হবিগঞ্জের এক আসামি শর্ত ভঙ্গ করায় তার জামিন বাতিলের জন্য আদালত বসেছিল। এছাড়া মামলার দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য মাঝে মধ্যে আদালত বসলেও পুরোপুরি মামলার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি।

করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয় সরকারি সব অফিস। খুলে দেয়া হয় বিচারাঙ্গনও। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম।

যদিও করোনার মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শারীরিক ও ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে কার্যক্রম চলেছে। বিচারিক (নিম্ন) আদালতের কার্যক্রমও সীমিতভাবে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে ‘সীমিত আকারে’ কোর্ট পরিচালনার কোনো বিধান না থাকায় প্রায় ছয় মাস ধরে এর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তবে মাঝে মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়।

করোনার ছোবল থেকে মুক্তি মেলেনি ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের। সেখানকার ডরমেটরিতে থাকা এপিবিএনের বেশ কয়েকজন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। জুন মাসের মাঝামাঝি আক্রান্ত হন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত ও তার স্ত্রী। এরপর একে একে আরও পাঁচ প্রসিকিউটর করোনা পজিটিভ হন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক বিচারপতি অসুস্থতার কারণে ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ট্রাইব্যুনালের সার্বিক বিচার কার্যক্রম।

করোনার প্রকোপ কমে আসায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মো. শাহিনুর ইসলাম এবং বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শন করেন। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, আইটি অফিসারসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ট্রাইব্যুনালে আসেন। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ফের শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম।

ওইদিন মানবতাবিরোধী মামলার আসামি এবং ঝিনাইদহের আব্দুর রশিদ নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি করে তা খারিজ করে দেন আদালত। এছাড়া হবিগঞ্জের অপর এক মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জবানবন্দি শেষে ডিফেন্স টিমের সাক্ষীর জেরার জন্য আগামী ৩০ অক্টোবর পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।

যদিও ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য (বিচারপতি আমির হোসেন) বর্তমানে ভারতে চিকিৎসাধীন। তার অনুপস্থিতিতে মামলার রায় ঘোষণা, চার্জ (অভিযোগ) গঠন এবং চার্জ গঠনের আগে ফরমাল চার্জ আমলে নেয়ার বিষয়টি বন্ধ। এই তিন কার্যক্রম ছাড়া মামলা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

পূর্ণাঙ্গ ট্রাইব্যুনাল না হলে রায়সহ যে তিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নয়

আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের দুজন বিচারপতি কোনো মামলার রায় ঘোষণা, ফরমাল চার্জ আমলে নেয়া এবং চার্জ (অভিযোগ) গঠন করতে পারবেন না। তবে এই তিন কার্যক্রম ছাড়া, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, আসামিকে কাস্টডিতে পাঠানো, মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন-তারিখ ঠিক করাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল।

traibunal-02.jpg

চেয়ারম্যানসহ ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্যের বিচারিক এখতিয়ারের বিষয়ে জানতে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার সাঈদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি করোনা পরিস্থিতির কারণে কারও সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা করবেন না বলে জানান। ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ডেপুটি রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা অমিত কুমার দে-ও কল রিসিভ করেননি।

পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এখতিয়ারের বিষয়ে প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনার মধ্যেও একেবারে যে কাজ চলেনি, তা কিন্তু নয়। বিচারকাজ সীমিত আকারে চলেছে। মামলার ধার্য তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। অন্য কোনো আবেদন থাকলে সেটিও নিষ্পত্তি করেন আদালত। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য (বিচারপতি) অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। এখন মুম্বাইয়ে আছেন। তিনি না আসা পর্যন্ত মামলার আনুষ্ঠানিক শুনানি হচ্ছে না। এখন যেহেতু ট্রাইব্যুনাল খুলছে, আশা করি দ্রুত বিচারকাজ এগিয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল একটি বিশেষ আইনে চলে। এটি অন্য যেকোনো আইন থেকে আলাদা। আসামি গ্রেফতার থাকলে তার উপস্থিতিতে বিচারকাজ পরিচালনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। করোনার কারণে আসামিদের হাজির করা যাচ্ছিল না। এ কারণে বিচারকাজ সীমিত ছিল। এখন খোলা হয়েছে, বিচারকাজেও গতি আসছে। রায় ঘোষণাসহ তিনটি কাজ ব্যতীত সব বিচারিক কাজের সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন আদালত।’

সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘গত ১৭ মার্চ আদালত বসেছিল। সেদিন মহেশখালীর মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। তখনই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় দেশে। পরবর্তীতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি বিবেচনায় বিচারকাজ বন্ধ রাখা হয়। অর্থাৎ মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ সীমিত করা হয়।’

‘ট্রাইব্যুনালের রায় দিতে গেলে চেয়ারম্যানসহ তিন সদস্যের (চেয়ারম্যান ও দুই বিচারপতি) প্রয়োজন হয়। একজন সদস্য অসুস্থ। এ কারণে বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ বিচারকাজ শুরু করার মতো পরিস্থিতি হয়নি। এছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, অসুস্থ, বয়স্কদের কর্মস্থলে আসা, না আসার একটি বিষয় আছে। যারা ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত (বিচারপতি, তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউটর) তাদের প্রায় সবার বয়স ৬০ বছরের ওপর। এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে ঝুঁকি নেয়া কি সম্ভব? তারপরও আমরা আদালতে আসছি।’

সৈয়দ হায়দার আলী আরও বলেন, ‘আসামিদের মধ্যেও সবাইকে হাজির করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ অধিকাংশ আসামিই বয়স্ক। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনের পারস্পরিক যোগসাজশে চলছিল আদালত। এখন ফের বিচারিক কাজ শুরু হয়েছে, আশা করি গতি পাবে।’

একজন বিচারকের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এখতিয়ারের বিষয়ে অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেয়া, ফরমাল চার্জ গঠন এবং কোনো মামলার রায় ঘোষণা করতে পারবেন না। বাকি সব কাজ করতে পারবেন। যেমন- আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, আসামিকে হাজতে প্রেরণ— এগুলো করতে পারবেন।’

‘যারা জেলে আছেন, তারাও ন্যায়বিচার চান। করোনার কারণে তাদের তো আর ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ট্রাইব্যুনালে যেহেতু বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এখন ধরা যায় উত্তর উত্তর সবকিছু আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারব আমরা।’

ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম. সানাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকার পর ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ফের চালু হয়েছে। এটা খুবই আশার কথা। এখন মামলার শুনানি হলে কাজের গতি আরও বাড়বে। সামনে আরও দুই- তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আমরা প্রস্তুত রেখেছি। করোনা মহামারির মধ্যে আরও তিনটি প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দিয়েছিলাম। এখন যেহেতু কোর্ট চালু হয়েছে, বিচারের গতিও বাড়বে।’

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬ মামলা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩৬ মামলার মধ্যে ২০টিরও বেশি মামলা চার্জ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে ময়মনসিংহের খলিলুর রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার রায় আসামি ও প্রসিকিউশন পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২৬ জানুয়ারি ঘোষণার জন্য (সিএভি) অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের চারটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- আবুল কালাম ওরফে মো. সামসুজ্জামান কামাল, মো. আব্দুল্লাহ, আকিল আলী ওরফে মো. রিয়াজ উদ্দন আজাদী, মো. আব্দুল লতিফ, মো. আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা ও সিরাজুল ইসলাম। পলাতক আছেন এ এফ এম ফয়জুল্লাহ ও মো. আমিন উদ্দিন খান। মারা গেছেন নুরুল আমিন শাজাহান ও মো. আব্দুল মালেক আকন্দ।

সর্বশেষ রায় ১১ ডিসেম্বর

২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর বোয়ালিয়ার ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় কর্মী মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের মামলার রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি আমির হোসেন ও বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

এরপর আর কোনো রায় ঘোষণা করা হয়নি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এখন পর্যন্ত (১০ বছরে) ৪১টি মামলায় মোট ১০৫ আসামির মধ্যে ৯৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

এফএইচ/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।