‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’ আগে ছিল এখন নেই!
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়। এখানেই আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নামে। ২০০৯ সালে সড়কটি উদ্বোধন করার পর ১১ বছর হলেও সড়কটির প্রকৃত নাম জানেন না এখানকার বাসিন্দারা।
সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সড়কটির আশপাশের বাসিন্দা এবং পথচারী মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তাদের কাছে প্রশ্ন করা হয় ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’টি কোথায়? উত্তরে শুধু একজন বলেন, ‘এটাই ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’।
উত্তরদাতার নাম মো. বিল্লাল। পেশায় তিনি প্রাইভেটকারচালক। ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ অঞ্চলে ১৯ বছর ধরে আছি। ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নাম দিয়ে ২০০৯ সালে এই সড়কের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পর কিছুদিন কয়েকজন সড়কের এই নাম বলতেন। কিন্তু এখন কেউ এই নাম বললে চিনবে না। সবাই এই সড়কের নাম ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড বলে জানে। এটি আগে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক ছিল, এখন ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার নামে এই সড়কটি করা হলেও হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড়া আর কোথাও এই নাম ব্যবহার হয় না। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, ইন্টারনেটের বিল সবকিছুতেই লেখা থাকে ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড।’
শাহবাগ থেকে যাওয়ার পথে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের ওভার ব্রিজ পার হয়ে একটু দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোলেই ‘ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড’ হিসেবে পরিচিত সড়কটির মোড়ে চোখে পড়বে ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’ নামের একটি ম্যুরাল। যেখানে ডা. গোলাম মাওলার জন্ম-মৃত্যুর সালসহ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা ম্যুরালটি কিছু কিছু লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
সবকিছুর বিলে ধানমন্ডি ১ নম্বর রোড লেখা থাকে
যে স্থানটিতে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়কের ম্যুরাল রয়েছে তা এক প্রকার রিকশাস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। সব সময় মোড়টিতে যাত্রী নেয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে বেশকিছু রিকশা। সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোড়টিতে যেতেই কয়েকজন রিকশাচালক হাঁক দিয়ে বলে ওঠেন, ‘মামা কোথায় যাবেন?’
এ সময় সাতজন রিকশাচালককে বলা হয়, ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক যাবেন?’ উত্তরে প্রত্যেকে বলেন, ‘মামা এটা কোথায়? ধানমন্ডির ভেতরে নাকি মোহাম্মদপুর?’
তাদের প্রত্যেকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘এ সড়কের নাম কী?’ উত্তরে তারা সবাই বলেন, ‘ধানমন্ডি-১ নম্বর সড়ক।’ এমনকি ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়কের ম্যুরালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় চারজন রিকশাচালক একই কথা বলেন।
এ সময় জাহাঙ্গীর নামের এক রিকশাচালককে ম্যুরালের লেখা পড়তে বললে তিনি উচ্চস্বরে পড়েন, ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’। এটা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য রিকশাচালকরাও কিছুটা অবাক হন এবং কয়েকজন বলে ওঠেন, ‘এটাই ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক?’
একটু স্তব্ধ থেকে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আসলে এই নাম কেউ বলে না। সবাই ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড বলে। এই মোড়কে সবাই ১ নম্বর রোডের পুলিশ ক্যাম্প বলে চেনে। ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক বললে কেউ চিনতে পারবে না। আমি তিন বছর ধরে এখানে রিকশা চালাই, কিন্তু এর আগে কোনো দিন ম্যুরালের লেখা পড়ে দেখিনি।’
সবাই ধানমন্ডি ১ নম্বর রোড বলে জানে
এদিকে সড়কটির দুই পাশে যেসব বাসাবাড়ি বা অফিস আছে তার কোথাও সড়কের নাম ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’ লেখা নেই। প্রতিটি ভবনের ঠিকানায় লেখা আছে ‘ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড’।
সড়কটির শেষ প্রান্তের একটি ভবনে ১২ বছর ধরে বসবাস করেন বেসরকারি কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন। তার কাছেও জানতে চাওয়া হয়, ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়কটি কোথায়?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাই, এই সড়কের নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।’
এ সময় তাকে বলা হয়, এই সড়কের শুরুতে তো ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক লেখা রয়েছে। এতে কিছুটা বিস্মিত হয়ে তিনি বলেন, ‘বলেন কী! এটাই ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক? আসলে কেউ এই নাম বলে না। এ কারণে আমরাও জানতে পারিনি। গাড়িতে চলাফেরা করি, তাই রাস্তায় কোথায় লেখা আছে তা খেয়াল করিনি।’
একজন ভাষাসৈনিকের নামে নামকরণ করা হলেও সড়কটির নাম পরিবর্তন হওয়াকে কীভাবে দেখছেন— এমন প্রশ্ন করা হলে কামাল উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তার নাম শুধু নামফলকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হয়নি। এ নিয়ে প্রচারণা চালানো উচিত ছিল। পাশাপাশি সরকারি নথিতেও রাস্তার নাম ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক করা উচিত ছিল। অন্তত বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলে এই নাম ব্যবহার করা হলেও বাসিন্দারা রাস্তাটির প্রকৃত নাম জানতে পারতেন। কিন্তু কোথাও এ নাম ব্যবহার করা হয় না। সব জায়গায় ধানমন্ডি-১ নম্বর রোড ব্যবহার করা হয়।’
এ ধরনের সড়কের দাফতরিক নামগুলো ব্যবহার করা দরকার জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম বাবলা বলেন, ‘এসব সড়কের নাম ধানমন্ডির মানুষ তেমন ব্যবহার করে না। তবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখতে এসব সড়কের দাফতরিক নামগুলো ব্যবহার করা দরকার। এতে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। আমি এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব। সড়কগুলোর ফলক আরও দৃশ্যমান করবো।’
এমএএস/এমএসএইচ/এসএইচএস/জেআইএম