‘অনিয়মের নির্বাচন রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৪৫ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২২
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার

ড. বদিউল আলম মজুমদার। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। কাজ করছেন দাতব্য সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি হিসেবে। পালন করছেন নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও।

চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: দলীয় প্রতীকে দ্বিতীয়বারের মতো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্যাপক সহিংসতা আর অনিয়মের খবরও আসছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। নিশ্চয় পর্যবেক্ষণ করছেন নির্বাচন পরিস্থিতি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এক দশক ধরে নির্বাচনের যে সংস্কৃতি বিরাজ করছে, তা থেকে বিশেষ একটি নির্বাচনকে আলাদা করে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশে আর কোনো নির্বাচন সঠিক নিয়মে হয়নি। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করেছিল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু তাতে বুমেরাং হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভোট সুষ্ঠু করে দেখাতে চেয়েছিল নিজ দলের জনসমর্থন যাচাই করতে। চারটিতেই ভরাডুবি হয়। এরপর আর ঝুঁকি নিতে চায়নি আওয়ামী লীগ। যার ফলাফল আমরা প্রতিটি নির্বাচনেই এখন দেখতে পাচ্ছি।

নির্বাচন মানেই এখন আতঙ্কের চিত্র। খুন, সহিংসতা প্রতিটি নির্বাচনে সংঘটিত হচ্ছে। অসংখ্য জায়গায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। টাকা আছে যার বা ক্ষমতার কাছে যিনি অবস্থান করছেন, তিনিই নির্বাচনে জিতে আসছেন এবং সেটা যেভাবেই হোক না কেন। এই পরিস্থিতি তো বড় রোগের লক্ষণ। অনিয়মের নির্বাচন রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে। অর্থবৃত্তে ঘেরা এমন নির্বাচনে কোনোভাবেই জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটছে না।

‘অনিয়মের নির্বাচন রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে’নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকার প্রার্থী ও দুইবারের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে

নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ করতে হলে রাজনীতি কুলুষমুক্ত করতে হবে। অর্থের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সমাজে যে অসঙ্গতি, দুর্নীতি বিরাজ করছে তা রোধ করতে হবে। দুঃশাসন থামাতে হবে। যদিও এসবের জন্য রাজনীতিই দায়ী। তার মানে একটি পরিষ্কার করতে পারলে অন্যটিও পরিষ্কার হবে।

জাগো নিউজ: এক দশকের নির্বাচনী চিত্রের কথা বললেন। কিন্তু এত কিছুর পরও এবারের স্থানীয় নির্বাচনে ব্যাপক অংশগ্রহণ হচ্ছে, এমনটি বলছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ক্ষমতাসীন দল বলছে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে বলেই সহিংসতা হচ্ছে। আসলে কি তাই?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: যারা বলছেন, তার ঠিক পর্যবেক্ষণ করে বলছেন না। নির্বাচন আগের চেয়ে কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকে। প্রার্থী থাকে রেকর্ড সংখ্যক। এবার বহু কম। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বহুজন নির্বাচিত হচ্ছেন। অনেক জায়গায় অন্য দলের প্রার্থীরা প্রচার করতে পারছেন না। পোস্টার লাগাতে পারছেন না। আগে পরিবারভিত্তিক, বংশভিত্তিক প্রার্থী থাকত। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন সে সৌন্দর্য নষ্ট করে দিচ্ছে। আনন্দের পরিবর্তে হতাশা আর হিংসা নেমে আসছে।

আর ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তারা যেনতেনভাবে ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখাচ্ছে। প্রবাসী, মৃত মানুষের ভোটও দিয়ে দিচ্ছে। এটি তো একটি রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বার্তা এবং তা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে। এই জালিয়াতির জন্য সরকার বা নির্বাচন কমিশনের কোনো ব্যাখ্যা নেই, অনুশোচনা নেই। নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণের জন্য কেউ আর তাদের কথা বিশ্বাস করে না। বড় ক্ষতি হয় গেল।

জাগো নিউজ: প্রধান বিরোধী জোট এবার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছে। এমন বর্জনে আসলে কী অর্জন হয়?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিএনপি এখন শাঁকের করাত। একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন নির্বাচনে অংশ না নিলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপির এখন সেই অবস্থা। কী করবে তারা বুঝে উঠতে পারছে না।

‘অনিয়মের নির্বাচন রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে’ড. বদিউল আলম মজুমদার

তবে নির্বাচন বর্জনের মধ্য বিএনপি অন্যদিকে লাভবান হচ্ছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেরা হানাহানি করছে, এটিই বিএনপির অর্জন। নির্বাচনে সহিংসতায় আওয়ামী লীগের লোকেরা দলীয় কর্মীকে হত্যা করছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ এখন ব্যাপক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এটি বিএনপির সঙ্গে হওয়ার কথা ছিল। হয়নি। তার মানে আওয়ামী লীগ নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জাগো নিউজ: একতরফা হলেও স্থানীয় নির্বাচন কিছুটা সুষ্ঠু দেখানো হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন, আর সেটা সামনের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেই। আপনি কী মনে করছেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমি তা মনে করি না। সরকারের এমন কৌশল নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। কারণ পুলিশ প্রশাসন দিয়েই সরকার সব করে নিচ্ছে। জনগণের ভোটের তো আর দরকার পড়ে না। নির্বাচন কমিশন ভোট সুষ্ঠু করার ক্ষমতা রাখে জনগণ তা বিশ্বাসও করে না।

জাগো নিউজ: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী দেখছেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এখানেও আলাদা করে দেখার কিছু নেই। সরকার যে কোনো মূল্যে নৌকাকে জিতিয়ে আনবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেলিনা হায়াৎ আইভী তারকা প্রার্থী। আবার শামীম ওসমানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব আছে। এখানে নৌকা হারলে সরকারের জনসমর্থনে ভাটা পড়ছে বলে দেখানো হবে। এই ঝুঁকি সরকার কোনোভাবেই নিতে চাইবে না।

এএসএস/এইচএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।