আকর্ষণের কেন্দ্রে আয়া সোফিয়া মসজিদ, নজর কাড়ে স্থাপত্যশৈলী

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ তুরস্ক থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০৭:০৮ পিএম, ০৪ মার্চ ২০২২

# সব ধর্মের মানুষ ঢুকতে পারেন আয়া সোফিয়ায়
# পুরুষদের ফুলপ্যান্ট, নারীদের হিজাব বাধ্যতামূলক

নান্দনিক আর নজরকাড়া স্থাপত্যের নিদর্শন নিয়ে প্রায় ১৫শ বছর ধরে মাথা উঁচু করে আছে ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া। সবশেষ রূপান্তরের পর এটি এখন আবারও ব্যবহৃত হচ্ছে মসজিদ হিসেবে। যদিও আয়া সোফিয়া ঘিরে কিছুটা রাজনীতি, বিভেদ এবং আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তারপরও সবকিছু ছাড়িয়ে আয়া সোফিয়ার স্থাপত্যকীর্তি আর এর শৈল্পিক আবেদন সব ধর্মের দর্শনার্থীরই মন কাড়ে।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের জুলাইয়ে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে দ্বিতীয় দফায় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন মসজিদটিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান-জামাত হয়। তবে জাদুঘর থেকে একে পুনরায় মসজিদে রূপ দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে সমালোচনা হয়েছে। কারণ স্থাপনাটি কখনো অর্থডক্স গির্জা, কখনো ক্যাথলিক গির্জা, কখনো মসজিদ আবার কখনো জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এখন আয়া সোফিয়া তুরস্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থলে পরিণত হয়েছে।

আয়া সোফিয়ার বিচিত্র ইতিহাস

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আয়া সোফিয়া মসজিদের ফটকে একটি বোর্ডে ইংরেজি এবং তুর্কি ভাষায় লেখা স্থাপনাটির ঐতিহ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ৫৩২ সালে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে আয়া সোফিয়া নির্মাণ শুরু হয়েছিল। তখন ইস্তাম্বুল শহরের নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল, যা ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। যাকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যও বলা হয়। এটির নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।

jagonews24

প্রায় ৯০০ বছর ধরে আয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। অবশ্য মাঝখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একটি সংক্ষিপ্ত কালপর্ব ছাড়া, যখন চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিকরা এক অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা আয়া সোফিয়াকে একটি ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালে পরিণত করেছিল। পরে ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এর নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। চিরকালের মত অবসান হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আয়া সোফিয়ায় ঢুকে এটির সংস্কার করে মসজিদে পরিণত করতে নির্দেশ দেন বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ। তিনি এই ভবনে প্রথম শুক্রবারের নামাজ পড়েন। তার আগে অটোমান স্থপতিরা আয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থডক্স খ্রিস্টান ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতীক-চিহ্নগুলো সরিয়ে ফেলেন বা পলেস্তারা দিয়ে ঢেকে দেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয় উঁচু মিনার।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো তাদের ভূখণ্ডকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলে। তবে ওই সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকেই জাতীয়তাবাদী তুর্কি শক্তির উত্থান হয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক তুরস্ক। তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের নির্দেশে আয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে পরিণত করা হয়। তখন এক আইনে ভবনটিতে ধর্মীয় প্রার্থনা নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৩৫ সালে আয়া সোফিয়াকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

আয়া সোফিয়া পরিচালনায় সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ইলমেন। এক দোভাষীর সাহায্যে আলাপকালে তিনি জানান, ইসলামপন্থি গোষ্ঠী এবং ধার্মিক মুসলমানরা শুরু থেকেই আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করতে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৪ জুলাই আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ঠিক ছিল না বলে রায় দেয় আদালত। পরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক বিরাট ভুল। তখন তিনি আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানানোর এক আদেশে সই করেন। ২০২০ সালের ১০ জুলাই ৮৬ বছর পর আয়া সোফিয়ায় আজান দিয়ে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

সরেজমিন

বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম পাড়ে ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় বিশাল গম্বুজশোভিত ঐতিহাসিক ভবন আয়া সোফিয়া। দূর থেকে খুব সহজেই দর্শকদের নজর কাড়ে স্থাপনাটি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দেখা যায়, সুবিশাল এই স্থাপনা সবার জন্য উন্মুক্ত। এর স্থাপত্যশৈলী জনমনে বিস্ময়ের যোগান দিচ্ছে। আয়া সোফিয়ায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই এর বিশালতা আর নান্দনিকতায় মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

স্থাপনাটির প্রধান কক্ষটি বিশাল। ছাদের সোনালি গম্বুজটি মেঝে থেকে কমপক্ষে ১৫০ ফুট উঁচুতে। সামনে থেকে দেখতে সেটি আরও অনেক বেশি উঁচু মনে হয়। গম্বুজের ছাদ থেকে তারের সাহায্যে ঝুলে আছে চোখ ধাঁধানো ঝাড়বাতি। সেগুলোর আলোয় ঝলমল করে ওঠে স্থাপত্যের ভেতরটা। গম্বুজে খোদাই করে বসানো হয়েছে পবিত্র কোরআনের আয়াত। এর সামনের অংশে নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে পৃথক নামাজের জায়গা। সেখানে চলছে নামাজ আদায়। মসজিদ হলেও আয়া সোফিয়ায় বিভিন্ন ধর্মের নারী-পরুষদের ঢুকতে দেখা গেছে। তারা স্থাপনাটির কাঠামো দেখে অবাক হচ্ছেন। ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। তবে সেখানে ঢুকতে পুরুষদের ফুলপ্যান্ট এবং নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। এভাবে দিনে কয়েক হাজার দর্শনার্থী মসজিদে ভিড় করেন।

২০২১ সালের ২৪ জুলাই আয়া সোফিয়া পুনরুদ্ধারের বর্ষপূর্তিতে তুরস্ক সরকারের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তুরস্কভিত্তিক ডেইলি সাবাহর খবরে বলা হয়, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিভিন্ন বিধিনিষেধ ছিল। তারপরও এক বছরে মসজিদটিতে ৩০ লাখের বেশি মানুষ ভ্রমণ করেন।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকার বাসিন্দা আবু আহমেদ। মেহেট আকিফ এরসয় পার্ক সংলগ্ন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আসরের আজান শুনে জামাতে নামাজ পড়তে আয়া সোফিয়ায় যান তিনি। নামাজ শেষে ফেরার পথে এক দোভাষির সাহায্যে কথা হয় তার সঙ্গে।

আলাপকালে আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আয়া সোফিয়ার হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা দিনে অন্তত তিন-চার ওয়াক্ত নামাজ এই মসজিদে পড়ি। এতে মনে প্রশান্তি কাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মসজিদটি দেখতে আসেন পর্যটকরা, এটি আমাদের জন্য আনন্দের।

তুরস্কে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাইফুল ইসলাম। ইস্তাম্বুলে গ্র্যান্ড বাজারে প্রসাধনীর ব্যবসা করেন। আলাপকালে তিনি বলেন, আয়া সোফিয়ার অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তি দেখতে বিশ্বের বহু দেশ থেকে তুরস্কে আসছেন পর্যটকরা। সেখানে বাংলাদেশেরও প্রচুর পর্যটকের দেখা মিলছে। বিশেষ করে আয়া সোফিয়া মসজিদ হওয়ার পর পর্যটকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

এমএমএ/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।