ডিবির পোশাক পরে অপরাধ, প্রযুক্তিতে খোঁজা হচ্ছে সমাধান

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০২২
প্রতীকী ছবি

গায়ে ডিবির জ্যাকেট। কোমরে চামড়ার বেল্টে অস্ত্র। হাতে ওয়াকিটকি আর হ্যান্ডকাফ। প্রথমে দেখে যে কেউ ধরে নেবেন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্য। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও সন্দেহ হবে না। এই ছদ্মবেশে পুলিশের মতো অভিযান চালাতো একটি প্রতারক চক্র। নির্জন সড়কে ভুয়া চেকপোস্ট বসিয়ে করতো ছিনতাই ও ডাকাতি।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত কয়েক বছরে চক্রটির বেশ কয়েকজন সদস্য আটক হয়েছেন। অনেক সময় সাজানো এসব ঘটনার দায় গেছে ডিবির ওপর। ডিবির পোশাক, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি কীভাবে প্রতারকচক্রের হাতে যাচ্ছে তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। প্রতারণা ঠেকাতে সম্প্রতি পোশাকে বিশেষ কিউআর কোড বসানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ডিবির ঊর্ধ্বতনরা।

গত ১৩ জুলাই রাজধানীর বসিলা এলাকা থেকে এমনই একটি চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ।

পুলিশ বলছে, গ্রেফতার চারজন ডিবির ভুয়া পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে বেড়াতেন। কোরবানির ঈদ টার্গেট করে বড় বড় পাইকারের পিছু নিতেন তারা। এরপর সুবিধাজনক নির্জন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি থামিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকা সব লুট করে নিতেন তারা।

গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার সামনে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল তিন ডাকাত। তাদের কাছে ছিল ডিবি পুলিশ লেখা সাদা একটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ওই স্থানে অভিযান চালায় গোয়েন্দা ওয়ারী বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিম।

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে একটি ওয়ারলেস সেট, দুটি লাঠি, দুটি ডিবির জ্যাকেট, দুটি হ্যান্ডকাফ, একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস ও একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়।

২০২০ সালের ২১ অক্টোবর ফেনীর দাগনভূঞায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ২৮ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী আবু জাফর শাহীনের দাবি, তিনি ইসলামী ব্যাংক দাগনভূঞা শাখা থেকে ২৮ লাখ টাকা তোলেন। টাকা একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে সন্ধ্যার আগে মোটরসাইকেলে সোনাগাজীর কুঠিরহাট ফিরছিলেন। পথে দাগনভূঞার উত্তর আলীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে একটি সাদা প্রাইভেটকার তার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। এসময় গাড়ি থেকে চার যুবক নেমে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ব্যাগে ইয়াবা আছে বলে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে গাড়িতে তোলেন।

শুধু ডিবি নয়, আইজিপির আত্মীয়-সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা
নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, আইজিপির আত্মীয় ও সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এমন অভিযোগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এএএম সালাউদ্দিন ভূইয়া (৫৫) নামে একজনকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সালাউদ্দিন ভূইয়া নিজেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল পরিচয় দিতেন। তার কাছ থেকে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত বাঁধাই করা একটি ফটোফ্রেম, সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত একটি গেঞ্জি, ক্যাপ, মানিব্যাগ ও মেডেল, চারটি জাল লেটার প্যাড, একটি জাল সিল, দুটি জাল ক্রয়াদেশ, দুটি জাল সোয়াচ প্যাড, দুটি চেকবই, তিনটি মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন কনটেন্ট জব্দ করে র্যাব।

ডিবির পোশাক পরে অপরাধ, প্রযুক্তিতে খোঁজা হচ্ছে সমাধান

ডিবি পরিচয়ে অপরাধ করার সময় ধরা পড়া চক্র

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা কিংবা মন্ত্রী-নেতা পরিচয়ও দেন কেউ কেউ। নিজেকে মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন আবু হোরায়রা ওরফে খালিদ। তার কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোনসেট ও তিনটি ভুয়া নামে নিবন্ধিত সিমকার্ড জব্দ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বুথ বা ব্যাংকের সামনে, যেখানে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয় সেখানে প্রতারকদের সোর্স থাকে। আবার গার্মেন্টসে বেতন দেওয়ার সময় গাড়িতে করে টাকা আনা হয়। সেখানেও অপরাধীরা সোর্সের মাধ্যমে নজরদারি করে ডাকাতির চেষ্টা করে। দীর্ঘদিন ধরে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনায় কখনো আসামি ধরা পড়লেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না। কেউ কেউ আবার এসব অপরাধে কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশে অনেকগুলো চক্র ডিবি পুলিশ সেজে প্রতারণা করছে। অনেক সময় তারা গাড়িতে ডিবি পুলিশ লিখে জোরপূর্বক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে গাড়িতে তুলে টার্গেট ব্যক্তিদের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছে সবকিছু। এদের মধ্যে কয়েকজন বিভিন্ন অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য।

প্রতারণা বন্ধে ডিবির জ্যাকেটে আসছে কিউআর কোড প্রযুক্তি
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেটে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কুইক রেসপন্স কোড বা কিউআর কোড। ডিবির সব কর্মকর্তার তথ্য আগে থেকেই জমা থাকবে তাদের নিজস্ব সার্ভারে। মোবাইল অ্যাপ দিয়ে সদস্যের কিউআর কোড স্ক্যান করলেই তাদের পরিচয় চলে আসবে। যদি কোনো ভুয়া ডিবির পোশাকের কোড স্ক্যান করা হয় তাহলে ‘ইনভ্যালিড কিউআর কোড’ নামে একটি বার্তা দেখা যাবে।

ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তাদের সাধারণ পোশাকের ওপর একটি হাতাকাটা জ্যাকেট পরেন। সেটির সামনের দিকে ডানে ইংরেজিতে ‘ডিবি’ লেখা থাকে। বামে থাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লোগো। পেছনে ইংরেজিতে কেবলই ‘ডিবি, ডিএমপি’ লেখা থাকে।

ডিবির পোশাক পরে অপরাধ, প্রযুক্তিতে খোঁজা হচ্ছে সমাধান

এরইমধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কুইক রেসপন্স কোড সংবলিত জ্যাকেট প্রস্তুতের কাজ চলছে। নতুন পোশাকে বুকের ওপরই থাকবে কিউআর কোড। পোশাক তৈরিতে এমন কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে, যা শীত ও গরম উভয় ঋতুতে আরামদায়ক। এছাড়া পোশাকে এক ধরনের বিশেষ রং থাকবে, যার বিচ্ছুরণ থেকে আসল-নকল পুলিশের পার্থক্য ধরা যাবে। এমনকি বিশেষ ধরনের কাপড় দিয়ে এ পোশাক তৈরি করা হচ্ছে, যেন এটি বাজারে পাওয়া না যায়।

সাধারণ ইউনিফর্ম থাকায় প্রতারক ও অপরাধীরা সহজেই এমন ইউনিফর্ম তৈরি করে ভুয়া ডিবি সেজে ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণের মতো বড় অপরাধ সংঘটিত করছে। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই পরিবর্তন হচ্ছে ডিবির পোশাক।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ডিবি পুলিশ সব সময় বা সব জায়গায় চেকপোস্ট বসায় না। সুতরাং পুলিশ পরিচয়ে কেউ সবকিছু নিতে চাইলে ভেরিফাই করুন, আশপাশে পোশাকে অন ডিউটিতে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হোন। ভুয়া ডিবি পুলিশের অপতৎপরতা রোধে সবারই সচেতন হওয়া দরকার। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কিংবা যে কেউ যদি মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেন তাহলে পুলিশকে জানান, পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে মানিস্কট সেবা নিন। মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেনে গলিপথ এড়িয়ে চলুন, যেখানে সিসি ক্যামেরা আছে সেখানে বসে লেনদেন করুন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ডাকাতরা ডিবির মতো হুবহু জ্যাকেট তৈরি করে প্রচুর ডাকাতি করছে। জ্যাকেটগুলো বানানো খুবই সহজ। শুধু একটি ছাপ দিয়েই প্রতারকরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সব দায়-দায়িত্ব আসে ডিবির কাঁধে। ডিবির জ্যাকেট পরে কাজ করলে থানা পুলিশও মনে করে তারা ডিবি। আমরা তদন্ত করে দেখেছি বাইরের লোকজন ব্যাপকহারে ডিবির জ্যাকেট ব্যবহার করে।

এমন প্রতারণা থেকে উত্তরণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেটে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কুইক রেসপন্স কোড বা কিউআর কোড। শিগগির ডিবির সব সদস্যকে আলাদা কোড সংযুক্ত করে এ জ্যাকেট দেওয়া হবে। ফেব্রিক্সের একটি কাজ বাকি থাকায় কিছুটা দেরি হচ্ছে। বর্তমান জ্যাকেট অনেক পুরোনো, তাই আগের চেয়ে স্মার্ট প্রযুক্তিসম্পন্ন জ্যাকেট তৈরির কাজ চলছে।

এসব ভুয়া ডিবি অনেক সময় হ্যান্ডকাফ ব্যবহার করছে। তারা হ্যান্ডকাফ পাচ্ছে কোথায়? জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, হ্যান্ডকায় বাইরে পাওয়ার কথা নয়। আমাদের থেকে কিছু জিনিস খোয়া যায়। যারা অপরাধী তারা যে কোনোভাবে হ্যান্ডকাফ ম্যানেজ করে। অনেক সময় তাদের হাতে ওয়াকিটকি থাকে। এসব জিনিস দেখিয়ে অপরাধীরা প্রতারণা করে। মূলত প্রতারণা করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অনেক সময় ডিবি পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। সাধারণ মানুষ মনে করছে ডিবিই এসব অপরাধ করছে, কিন্তু আমরা (ডিবি) এসব কাজ করি না। আমরা গত এক মাসে অনেকগুলো ভুয়া ডিবির টিম গ্রেফতার করেছি। তবে সবকিছু থেকে উত্তরণের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

টিটি/এএ/জেআইএম

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেটে যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কুইক রেসপন্স কোড বা কিউআর কোড। ডিবির সব কর্মকর্তার তথ্য আগে থেকেই জমা থাকবে তাদের নিজস্ব সার্ভারে। মোবাইল অ্যাপ দিয়ে সদস্যের কিউআর কোড স্ক্যান করলেই তাদের পরিচয় চলে আসবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।