তিন কিওরেটরের দাবি

‘পাকিস্তানের ব্যাটাররা পারেনি তাই কোচ বলেছেন, উইকেট খারাপ’

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১০:০৮ পিএম, ২১ জুলাই ২০২৫

শেরে বাংলার উইকেট নিয়ে নেতিবাচক কথা অনেক পুরনো। বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেটে উইকেটের আচরণ নিয়ে সমালোচনা হয় প্রায়ই। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাই বিভিন্ন সময় শেরে বাংলার উইকেটের গতি, প্রকৃতি, আচার-আচরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন।

এ মাঠের উইকেট ভালো ক্রিকেট উপযোগি না। সীমিত ওভারের জন্য যেমন ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি বা আদর্শ ব্যাটিং উইকেট থাকার কথা, শেরে বাংলায় বেশিরভাগ সময়ই তা থাকে না। বেশির ভাগ সময় বল একটু স্লথ ও মন্থর গতিতে আসে। কখনো কখনো একটু-আধটু থেমে ব্যাটে আসে। বাউন্সটাও স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। কোনো সময় আবার একটু-আধটু টার্নও করে।

সব মিলিয়ে স্বচ্ছন্দে হাত খুলে ফ্রি স্ট্রোক খেলা একটু কঠিন। মোটকথা, শেরে বাংলায় একটু রয়ে সয়ে না খেলে ইচ্ছে মত বেপরোয়া, আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী ব্যাটিং করা কঠিন।

শেরে বাংলায় খেলা মানেই সবাই সতর্ক, সাবধানী। একটু দেখে, বুঝে আর রয়ে-সয়ে খেলাই এ মাঠের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। সেই কৌশল ও অ্যাপ্রোচের বাইরে গিয়ে অতি আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে ২০ জুলাই, রোববার মিরপুরে হোম অব ক্রিকেটে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন পাকিস্তানি ব্যাটাররা।

মোস্তাফিজ তাসকিন, তানজিম সাকিব আর শেখ মেহেদীর মাপা ও বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং এবং উইকেটের গতি ও চরিত্র না ঠাউরে নিজেদের মত অতি আক্রমণাত্মক উইলোবাজি করার চরম খেসারত দিয়েছে পাকিস্তান। মাত্র ১১০ রানে অলআউট হয়ে ৭ উইকেটে হেরেছে আগা সালমানের দল।

কিন্তু নিজেদের ভুল স্বীকার না করে এবং বাংলাদেশের বোলারদের বোলিং দেখে না খেলে পর্যদুস্ত হয়ে উল্টো পিচের সমালোচনা করেছেন পাকিস্তান হেড কোচ মাইক হেসন।

রোববার প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলা শেষে উইকেটের তীব্র সমালোচনা করে নিউজিল্যান্ড বংশোদ্ভুত পাকিস্তান হেড কোচ মাইক হেসন বোঝানোর চেষ্টা করেন, আসলে বাজে উইকেটের কারণেই পারেনি তার দল। এ উইকেটের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি বলে ওঠেন, ‘এটা মোটেই আদর্শ উইকেট ছিল না।’

তার কথা, ‘আমার মনে হয় না এটা কারো জন্যই আদর্শ উইকেট। যে দলটি এশিয়া কাপ আর ওয়ার্ল্ড কাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, সেই দলের জন্যই এই পিচ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য উইকেট নয়। যদিও আমাদের কিছু শটও উইকেট সম্পর্কে ভুল ধারণার উদ্রেক ঘটিয়েছে। তবে এই পিচ কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানের না। আমার মনে হয় না, দেশের বাইরে এ ধরনের পিচ কোনো কাজে লাগবে বাংলাদেশের। তবে আমি মনে করি, এই পিচে আগে ব্যাট করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং। এই পিচে প্রথম ব্যাট করে ১০০ না ১৩০ নাকি ১৫০ লড়াকু পুঁজি, তাও ঠাউরে ওঠা কঠিন। আমার মনে হয় না এই পিচ কারো জন্যই ভাল।’

পাকিস্তান হেড কোচের কথা শুনে মনে হয়েছে, শেরে বাংলার পিচ ছিল খুব খারাপ। এত খারাপ উইকেটে আগে খেলেনি তার দল। কথা কি সত্য? সত্যিই কি গতকাল ২০ জুলাইয়ের পিচ অত খারাপ ছিল? উইকেটের আচরণ কি সত্যিই অস্বাভাবিক ছিল?

যারা দেশের বিভিন্ন স্টেডিয়ামের উইকেট তৈরি করেছেন, নানা সময় শেরে বাংলায়ও কিওরেটরের দায়িত্ব পালন করেছেন, এই পিচ সম্পর্কে যাদের ধারণা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি, দেশের সেই তিন নামী প্রতিষ্ঠিত ও সিনিয়র কিওরেটর জাহিদ রেজা বাবু, বদিউল আলম খোকন ও শফিউল আলম বেলাল পাকিস্তান হেড কোচের মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। এই তিনজনের কেউ একবারের জন্যও হেসনের সাথে একমত পোষণ করেননি। বরং বলেছেন, যেভাবে বলা হয়েছে, উইকেটে তেমন কোন অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি।

এক কথায় উইকেট খারাপ ছিল না। এ উইকেটকে অগ্রহণযোগ্য বলার কোনোই অবকাশ নেই।

শেরে বাংলার অন্যতম প্রথম দেশী কিওরেটর বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘আমার একদমই মনে হয় না যে উইকেট খুব খারাপ ছিল। শেরে বাংলার পিচ সচরাচর যেমন থাকে বা যেমন আচরণ করে, তাই করেছে। মাত্রাতিরিক্ত খারাপ কিছু মনে হয়নি। ওভারঅল উইকেট ভাল ছিল। এ উইকেট নিয়ে কথা বলতে গেলে, আমি মনে করি ওয়েদারকে মাথায় রাখতে হবে।’

‘এখন বাংলাদেশে যে ওয়েদার, আমি গামিনি ডি সিলভাকে থ্যাংকস দেই। এই প্রতিকুল ওয়েদারে সে যে উইকেটকে খেলা উপযোগী রাখতে পেরেছে, সেটাই অনেক। টানা বৃষ্টি হয়েছে। রোদ পেয়েছে কম। পিচ কভারে ঢাকা ছিল বেশিরভাগ সময়। ফলে রোদ পায়নি। আমরা সাধারণতঃ উইকেট শুকাতে দুটি প্রক্রিয়া ফলো করি। এক রোদে শুকিয়ে। দুই ঘাস দিয়ে। ঘাসের ওপরের অংশটা মাটিকে শক্ত করে আঁকড়ে রাখার পাশাপাশি ওপরের স্তরটাকে শুকনো রাখে। ক্রমাগত ও টানা বর্ষণে তা সম্ভব হয়নি। রোদতো পায়ইনি। আর কভারে ঢাকা থাকায় ওই ঘাসটাও বেড়ে ওঠেনি। দুটার কোনটাই কাজে লাগাতে পারিনি।’

‘তারপরও যতটা বলা হয়েছে, তত খারাপ না। ওভারঅল বলতে গেলে, বলবো উইকেট ভাল। হ্যাঁ, শুরুর পর মানে প্রথম ৪/৫ ওভার আমার কাছে মনে হয়েছে বল থেমে এসেছে। একটা সময় উইকেট অনেকটাই নরমাল হয়ে পড়েছিল। তাই যদি না হবে, তাহলে পারভেজ ইমন এত স্বচ্ছন্দে ও সাবলীল ঢংয়ে হাত খুলে খেলতে পারতো না।’

খোকনের শেষ কথা, ‘উইকেট অভিযোগ করার মত না। পাকিস্তান জিতে গেলে কি এমন বলতেন?’

দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের কিওরেটরের দায়িত্ব পালন করা জাহিদ রেজা বাবু উইকেটের চেয়ে পাকিস্তানীদের ত্রুটিপূর্ণ রানিং বিটুইন দ্য উইকেটের সমালোচনা করেছেন।

জাহিদ রেজা বাবুর কথা, `উইকেট তত খারাপ ছিল না। পাকিস্তানের যে ৩টি রানআউট হয়েছে, সেই রানআউটগুলো বরং মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। প্রতিটি রানআউটের পিছনে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের কৃতিত্বের চেয়ে পাকিস্তানিদের দুর্বল, ত্রুটিপূর্ণ ও অদুরদর্শী রানিং বিটুইন দ্য উইকেটই দায়ী। সাধারণতঃ এক ম্যাচে এমন তিন-তিনটি খাপছাড়া রানআউট দেখা যায় না। যার একটির মধ্যেও কোনোরকম বুদ্ধিদীপ্ততা ছিল না। আমার মনে হয়েছে, ওই ৩ রানআউটই পাকিস্তানকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। না হয় রোববারের ম্যাচেও পাকিস্তানের স্কোর ১৫০ প্লাস হতে পারতো। আর তাহলে খেলার চালচিত্রও ভিন্ন হতে পারতো।’

জাহিদ রেজা বাবু যোগ করেন, ‘পাকিস্তান হেড কোচ যতটা খারাপ বলেছেন, উইকেট ততটা খারাপ ছিল না কোনোভাবেই। আমার মনে হয়, এই উইকেটেই দেখে ও বুঝে ব্যাট করলে পাকিস্তান হয়ত ১৫০-১৬০ করতে পারতো। তা হয়নি, তারা ভাল ব্যাট করতে না পারার কারণে এত সমালোচনার কোন মানে হয় না।’

‘হ্যাঁ, এই পিচের সমালোচনা করার মত সুযোগ ছিল। ২০২১ বিশ্বকাপের আগে আমরা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাথে যে পিচে খেলেছি, ওই পিচ নিয়ে এমন কথা বললে তবু মানা যেত। এখন রোববারের ম্যাচের পিচ নিয়ে অত খারাপ মন্তব্য করার আমি কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আবার বাংলাদেশ যদি ওই রান টপকাতে গিয়ে ৬/৭ উইকেট হারিয়ে ফেলতো, তাহলে আপনি বলতে পারতেন। লাস্ট বিপিএলে শেরে বাংলায় রান হয়েছে। হোম টিমতো একটা অ্যাডভান্টেজ নিবেই। ঢালাওভাবে এভাবে বলা ঠিক হয়নি।’

দীর্ঘদিন নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা স্টেডিয়ামের কিওরেটরের দায়িত্ব পালন করা শফিউল আলম বেলাল বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি লক্ষ্য করেন, শেষ ১৫ দিন প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হয়েছে। উইকেট রোদে শুকানোর সময় ও সুযোগই মেলেনি। যে বৃষ্টি হয়েছে, তার পানিতো আশপাশে নিচের আবরণে থেকেই যায়। তাই উইকেটের নিচের আবরণ একটু নরম ও ভিজা ছিল। উইকেটে ময়েশ্চার (আদ্রতা) ছিল। ৬/৭ ওভার পর বোঝা গেছে টপ ভিজা বা নরম। বোলারদের বুটের আঘাতে নীচের মাটি উঠে আসছিল। কাজেই পরিস্থিতি বিবেচনায় উইকেটের সমালোচনা করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই।’

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।