কী করছেন কোচ সালাউদ্দীন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ দলকে?
শুনতে কানে লাগলেও কঠিন সত্যি হলো, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের একটা বড় অংশের অস্ট্রেলিয়ান, বৃটিশ, দক্ষিণ আফ্রিকান আর নিউজিল্যান্ড একসেন্টের ইংলিশ বোঝায় সমস্যা আছে। জাতীয় দল ও তার আশপাশে এবং বিসিবির অভ্যন্তরে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারই বিদেশি কোচদের ইংরেজি ঠিকমত বোঝেন না।
তাদের পরামর্শ আত্মস্থ করতে পারেন না এবং দীর্ঘদিন ফরেন কোচের অধীনে খেলার পরও সে কারণেই নাকি টেকনিক, স্কিল ও টেম্পারামেন্টে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের উন্নতি কম। মূলত সে চিন্তা থেকেই দলের সাথে একজন সহকারি কোচ নিয়োগের সিদ্ধান্ত। আর ভাবা হয়েছিল সালাউদ্দীনই হতে পারেন, সে কাজে সবার চেয়ে দক্ষ। মনে করা হয়েছিল, সালাউদ্দীন কোচিং স্টাফে যুক্ত হওয়ায় সে সমস্যা কেটে যাবে।
তিনি যেহেতু ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আর বিপিএলে নিয়মিত কোচিং করান, জাতীয় পর্যায়ের প্রায় ক্রিকেটারকে খুব ভাল চেনেন, জানেন। কার কি সমস্যা এগুলো তার খুব ভাল জানা, তাই তার অন্তর্ভুক্তিতে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা উপকৃত হবেন। কোচদের সাথে ক্রিকেটারদের ভাব বিনিময়টা আগের চেয়ে ভাল ও সাবলীল হবে।
বিদেশি কোচদের কথা, পরামর্শগুলো ক্রিকেটাররা অনেক বেশি ভাল বুঝবেন, আত্মস্থ করতে পারবেন, অনেকেরই ভুল ত্রুটি শুধরে যাবে। সবারই কম বেশি উন্নতি ঘটবে। সালাউদ্দীন জাতীয় দলের কোচিং স্টাফ হলে ভাষা সমস্যা দূর হবে। সালাউদ্দীন সব বিদেশি কোচিং স্টাফ, ট্রেনার, ফিজিও, মনোবীদ আর অ্যানালিস্টের দোভাষীর কাজ করতে পারবেন।
এক কথায় পুরো কোচিং স্টাফের সাথে ক্রিকেটারদের মেলবন্ধন তৈরি করতে পারবেন। তাদের কথা, বার্তা আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে পারবেন। তাতে ক্রিকেটারদের টেকনিক, স্কিলের উন্নতি হবে। জাতীয় দল উপকৃত হবে।
কিন্তু তা কি হয়েছে? বরং যতদিন যাচ্ছে তাকে নিয়ে তীর্যক কথা-বার্তা, সমালোচনা বাড়বে। তার দলে থাকার যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সেই ২০২৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে জাতীয় দলে কাজ শুরুর পর মোহাম্মদ সালাউদ্দীন কি এমন কিছু করে দেখিয়েছেন, যা দেখে মনে হতে পারে তিনি দক্ষ, সফল ও সহায়ক?

সালাউদ্দীন তো হেড কোচ নন। তিনি ব্যাটিং, বোলিং, পেস-স্পিন বোলিং কিংবা ফিল্ডিং কোচও নন, তাহলে তাকে নিয়ে কেন এত তীর্য্যক কথা-বার্তা? দল কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছে না। বরং পারফরমেন্সের মান দিনকে দিন নিচের দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, সালাউদ্দীনতো হেড কোচ নন। তার ওপর দলের ব্যর্থতার দায় চাপানো কতটা যৌক্তিক?
এটা সত্য সালাউদ্দীন সে অর্থে হেড ও স্পেশালিস্ট কোচ নন। তবে ভেতরের খবর হলো, তিনি হেড কোচ না হলেও টিম বাংলাদেশের ওপর সালাউদ্দীনের প্রভাব প্রচুর। এক কথায় তিনিই কলকাঠি নাড়েন। তার অঙ্গুলি হেলনেই নাকি অনেক কিছু হয়। নীতি নির্ধারনী বিষয়গুলো মূলত সালাউদ্দীনই দেখেন। বাকিরা শুধু কোচিং করান। টিম কম্বিনেশন, একাদশ ঠিক করা, গেম প্ল্যান, ব্যাটিং অর্ডার সাজানোয়ও নাকি সালাউদ্দীনের ভূমিকাই বেশি।
বরং সালাউদ্দীনের বিপক্ষে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। ক্লাব ও বিপিএলে যাদের কাছে পেয়েছেন বেশি, সেই শেখ মেহেদী আর জাকের আলী অনিককে বেশি অগ্রাধিকার দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিপক্ষে। সেটা দেখাও গেছে। সোহানের মত দেশসেরা কিপার থাকার পরও জাকের আলী অনিককে দিয়ে কিপিং করানো হয়েছে। শেখ মেহেদীকে মাঝখানে ওপরে এনে চার নম্বরে সেট করার চেষ্টা হয়েছে। দুটিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মোটকথা, সালাউদ্দীন যে যে কারণে ও যা ভেবে কোচিং প্যানেলে রাখা হয়েছিল, তা পূর্ণ হয়নি।
খেলোয়াড়ী জীবনে মূলতঃ পেস বোলার ছিলেন সালাউদ্দীন। ক্লাব ক্রিকেটে পেসার হিসেবেই খেলতেন। নিচের দিকে ৯ থেকে ১০, ১১’তে ব্যাট করতেন। তবে কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের টেকনিক, স্কিল নিয়েও কাজ করেছেন প্রচুর এবং খেলোয়াড়দের ত্রুটি, বিচ্যুতি, দূর্বলতা খুঁজে বের করে তার সমাধান দেয়ার দাওয়াই আছে তার কাছে।
ব্যাটিং টেকনিক শেখাতে পারেন। ব্যাটারদের টেকনিক, স্কিল, টেম্পরামেন্ট বাড়ানোর ক্ষমতাও আছে বেশ। একজন কোচের যে ব্যক্তিগত দক্ষতা, মুন্সিয়ানা থাকা জরুরি, সালাউদ্দীনের সেটা আছে। তবে বাংলাদেশের মত দলে যেহেতু ব্যাটিং, বোলিং, পেস- স্পিন বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে স্পেশালিস্ট কোচ আছেন, সেখানে সালাউদ্দীনের আলাদা কিছু করার জায়গা নেই।

৮৮ সাল থেকে টানা ১০ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছেন ব্যাটার হিসেবে তার সামর্থ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রমাণিত। সমাদৃত। কোচিং প্রোফাইলটাও হেলাফেলার না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মূল দল, আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলের হেড কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন সিমন্স। বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টেও হেড কোচের ভূমিকায় ছিলেন এ ক্যারিবীয়।
কাজেই এমন এক অভিজ্ঞ, দক্ষ, কুশলী কোচ থাকার পর সালাউদ্দীন কেন পেছন থেকে কল কাঠি নাড়বেন? তিনিই কেন দল সাজাবেন? একাদশ ঠিক করবেন, ব্যাটিং অর্ডার সাজিয়ে দেবেন? এসব প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে।
এমন নয়, মোহাম্মদ সালাউদ্দীনের কোচিং প্রোফাইলও খুব খারাপ। অনুজ্জ্বল। তিনিও অবশ্যই দেশি কোচদের মধ্যে অন্যতম সেরা। সারোয়ার ইমরান আর খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে সালাউদ্দীনও দীর্ঘ সময় দেশের ক্রিকেটে ভাল কোচ হিসেবে সমাদৃত। সফলও। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে তত সাফল্য না পেলেও দেশি কোচদের বিপিএলে সালাউদ্দীন কোচ হিসেবে সবচেয়ে সফল।
এক কুমিল্লাই তার কোচিংয়ে চারবার বিপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেটা তাকে অনেক বেশি পাদপ্রদিপের আলোয় নিয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করতে শুরু করে দেন যে, দেশি কোচদের মধ্যে যেহেতু সালাউদ্দীন বিপিএলে সবচেয়ে বেশিবার দল চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন, তাহলে স্থানীয় কোচদের মধ্যে তার দক্ষতাই বুঝি সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু তিনি কোন দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে? তার দলে কারাকারা খেলেছেন? সেই দলটি কত শক্তিশালী, চ্যাম্পিয়ন হবার মত কি না? বাকিদের চেয়ে সমৃদ্ধ ও বেটার দল কি না? এসব সেভাবে কেউ খুঁটিয়ে দেখেনি। কুমিল্লার ফরেন কালেকশন ছিল সবার সেরা। বিপিএলের ইতিহাসে বেশিরভাগ সফল ও অতি কার্যকর পারফরমাররাই কুমিল্লায় খেলেছেন বেশি এবং বিগ ম্যাচ গুলোয় বিশেষ করে নকআউট স্টেজে ঐ সব বিশ্বতারকাদের একক নৈপুণ্য কুমিল্লাকে টেনে তুলেছে। সাফল্য পাইয়ে দিয়েছে।
আর সেটাই সালাউদ্দীনকে অনেক বেশি মিডিয়া কভারেজ পাইয়ে দিয়েছে। তিনি হয়েছেন আলোচিত। আলোড়িত কোচ। গায়ে লেগেছে সেরা কোচের তকমা। এর সাথে সাকিবের কোচ ও মেন্টর হওয়ার পর থেকে আরও আলোচনায় উঠে আসেন সালাউদ্দীন। সবার জানা সালাউদ্দীন নিজে বিকেএসপির ছাত্র। ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে ওঠা বিকেএসপি থেকেই। বিকেএসপিতে কোচিং ক্যারিয়ার শুরুও বিকেএসপি থেকে।
সেখান থেকেই সাকিব, মুশফিকের সাথে পরিচয় সালাউদ্দীনের। সখ্য। আন্তরিকতা। সাকিব বরাবরই তাকে ‘সালাউদ্দীন স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। সালাউদ্দীনের হাত ধরেই ২০০৫-২০০৬ মৌসুমে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে পা রাখেন সাকিব। পার্সোনাল কোচ হিসেবেও সালাউদ্দীনই সাকিবের ফাস্ট চয়েজ।
২০১৯ সালের ওয়ার্ল্ড কাপের আগে সাকিব যখন হায়দরাবাদের নিয়মিত প্লেয়ার, তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনুশীলন ও প্রস্তুতির জন্য সালাউদ্দীনকে একমাস হায়দরাবাদ নিয়ে গিয়ে নিজেকে তৈরির কাজে সালাউদ্দীনকে যুক্ত করেন সাকিব। খুব স্বাভাবিকভাবে অনেকেরই ধারনা জন্মে, দেশের আর কোন কোচকে না নিয়ে, না ডেকে সাকিবের মত বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সালাউদ্দীনকে নিজের ওয়ার্ল্ডকাপ প্রস্তুতির জন্য আইপিএল খেলার সময় ভারতে নিয়ে গিয়ে একটা বড় সময় ধরে কাছে রাখলেন।
তার অধীনেই প্র্যাকটিস করলেন, তার মানে তিনি সালাউদ্দীন না জানি কত বড়? সাকিব যখন তাকে মেন্টর ভাবে, তাকেই পার্সোনাল কোচ হিসেবে রাখে, তার মানে ‘হি ইজ সামথিং।’ আসলে তখন থেকে মনে করা হয় সালাউদ্দীনই দেশের কোচদের মধ্যে সবার সেরা। কোচ হিসেবে অনেক বড়।
সালাউদ্দীন যে কোচ হিসেবে ভাল না, বড় না; তা বলার কোনোই অবকাশ নেই। তবে আমার কথা হলো তাকে নিয়ে যত কথা হয়, হয়েছে, তাকে টেকনিক্যালি যত সাউন্ড, রিচ ভাবা হয়েছে তিনি তত দক্ষ ও বড় কিনা সেটা খুঁটিয়ে দেখার সময় এসেছে।
তিনি কোচ হিসেবে একটা দলকে কতটা গুছিয়ে দিতে পারেন? বাংলাদেশের মত সমস্যা সঙ্কুল দলের প্রধান সহকারী কোচ হিসেবে কি ভূমিকা রাখতে পারেন, কতটা কার্যকর হতে পারেন, সেটাই বিবেচনায় আনা উচিৎ ছিল।
সালাউদ্দীন কিন্তু প্রধান সহকারী কোচ। যার প্রধান কাজ হলো প্রধান বা হেড কোচকে সাহায্য করা। দলকে উজ্জীবিত রাখা। অনুপ্রাণিত করা। অন্যান্য কোচিং স্টাফের সাথে সমন্বয় করা এবং একজন বাংলাভাষী হিসেবে সব কোচের কথা, বক্তব্য, উপদেশ, পরামর্শ, নির্দেশ, টিপস সব ক্রিকেটারকে ঠিক মত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দেয়া।
ক্রিকেটারদের ব্যাট চালনা দেখে মনে হচ্ছে, তারা ঘুরে-ফিরে সেই তিমিরেই আছেন।
একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই, ৭ বছর আগে ২০১৮ সালে ভারতের দেরাদুনে আফগানিস্তানের সাথে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি চরমভাবে নাজেহাল হয়েছিল বাংলাদেশ। কারণ ছিল আফগান ‘স্পিন ম্যাজিশিয়ান’ রশিদ খানকে খেলতে না পারা। লেগি রশিদ তার লেগস্পিন, ফ্লিপার, আর গুগলি দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটারদের চরমভাবে পর্যদুস্ত করেন। তিনম্যাচে রশিদের ঝুলিতে জমা পরে ১৪ উইকেট। এক কথায় রশিদের স্পিন ‘ভেলকিতেই’ কুপোকাৎ হয় বাংলাদেশের ব্যাটাররা। এবারও ঠিক তাই।
ওয়ানডে সিরিজে আফগানদের জয়ের রূপকার, স্থপতি সেই রশিদ। এবারো ২ ওয়ানডেতে রশিদের কাছেই খাবি খাচ্ছেন তানজিদ তামিম, পারভেজ ইমন, সাইফ, তাওহিদ হৃদয়, জাকের আলী, মিরাজ ও সোহানরা। দুই খেলায় এরই মধ্যে (৩/৩৮ ও ৫/১৭) ৮ উইকেট জমা পড়েছে রশিদের ঝুলিতে। তারমানে কোনই উন্নতি নেই।
রশিদ খানকে আতবিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে স্বচ্ছন্দে খেলাতো বহুদূরে, তাকে খেলতে গিয়ে একেকজনের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’ অবস্থা। কোনো টেকনিক, স্কিল-এর বালাই নেই। যে যেমনে পারছেন, সেভাবে খেলতে চেষ্টা করছেন। গুগলি, সোজা ডেলিভারি আর কোনটা লেগস্পিন না বুঝে কেউ সুইপ, কেউ রিভার্সসুইপ আবার কেউবা পুল খেলতে গিয়ে একের পর এক আউট হচ্ছেন। সেখানে কোচিং স্টাফ বিশেষ করে সালাউদ্দীন কি করছেন? সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
শুধু টেকনিক-স্কিলই না, ধারণা করা হয়েছিল সালাউদ্দীন দলের সাথে থাকলে ক্রিকেটাররা মনের দিক থেকে চাঙ্গা হবেন। নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি, ঐক্য ও সংহতি বাড়বে। সব মিলে টিম স্পিরিটও বাড়বে বহুগুণে। একটা ইউনিট হয়ে উঠে মাঠে দল হিসেবে খেলবে বাংলাদেশ; কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। কেউ বলতে পারবেন না সালাউদ্দীন জাতীয় দলের সাথে যুক্ত হওয়ার পর ক্রিকেটার শরীরি অভিব্যক্তি, চলা ফেরা, কথা-বার্তায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টিম আরও বেশি চাঙ্গা হয়ে দল হিসেবে একটা ইউনিট হিসেবে গড়ে উঠেনি।
এআরবি/আইএইচএস