কেন দর্শক উপস্থিতি কম ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে?
যুক্তরাষ্ট্রে এই গ্রীষ্মে ফুটবল উৎসব বেশ জাঁজমকপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ এবং কনকাকাফ গোল্ড কাপের প্রথম এক-দুই সপ্তাহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃশ্য হয়ে উঠেছে দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম। আটলান্টায় চেলসি এবং এলএএফসি-র মধ্যকার ক্লাব বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে প্রায় ৪৮ হাজার আসন খালি ছিল, যা এই টুর্নামেন্টের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এবারের ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ হচ্ছে ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের ড্রেস রিহার্সাল। তিনটি দেশ আগামী বিশ্বকাপের যৌথ আযোজক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কানাডা এবং মেক্সিকোও রয়েছে। শুধু ক্লাব বিশ্বকাপই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে একই সঙ্গে চলছে কনকাকাফ গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টও।
ক্লাব বিশ্বকাপ আগে যে ফরম্যাটে আয়োজন হতো, সেটা হচ্ছে- আয়োজক দেশের ক্লাব এবং ৬টি কনফেডারেশন্স বিজয়ী ক্লাবসহ মোট ৮টি দল নিয়ে চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। মাত্র কয়েকদিনের একটা টুর্নামেন্ট।
তবে এবার ফিফা বাণিজ্যের নতুন ধারা যুক্ত করতে চাইলো ক্লাব বিশ্বকাপ ঘিরে। বিশ্বের সেরা সেরা ক্লাবগুলো খেলবে। খেলবে সেরা সেরা ফুটবলাররা। বিশ্বকাপের একটা চাঁছে ফেলা গেলে ছুঁটে আসবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। টাইটেল স্পন্সর, সম্প্রচারস্বত্ব মিলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ মিলবে এই টুর্নামেন্ট থেকে।
ফলে বিশ্বের সেরা ৩২টি ক্লাবকে বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়ায় ভাগ করে বাছাই করে আনা হলো। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানসিটি থেকে পিএসজি, লাতিন আমেরিকার বোটাফোগো, রিভার প্লেট থেকে শুরু করে এশিয়ার উরাওয়া রেড স্টিল কিংবা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড সিটি। প্রতিটি মহাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব রাখা হলো ক্লাব বিশ্বকাপে।
আয়োজক নির্ধারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র। আগামী বিশ্বকাপ যারা আয়োজন করবে, তাদের প্রস্তুতির একটা ওয়ার্মআপ হলো ক্লাব বিশ্বকাপ। ফিফার ধারণা, বিশ্বসেরা ক্লাব, ফুটবলারদের খেলা দেখার জন্য দর্শকরাও কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যায় করে ছুটে আসবে গ্যালারিতে।
কিন্তু ফিফার সে ধারণা ভুল প্রমাণ করলো এবারের ক্লাব বিশ্বকাপ। আশানুরূপ দর্শকের দেখা মিললো না ক্লাব বিশ্বকাপে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি এবং লা লিগা জায়ান্ট অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মধ্যে একটি ম্যাচ পাসাডেনার রোজ বোলে খেলা দেখতে ৮০,৬১৯ জন দর্শক উপস্থিত হয়েছিল।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার দল উলসান এইচডি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মামেলোদি সানডাউনসের মধ্যকার ম্যাচ দেখতে অরল্যান্ডোর ইন্টার অ্যান্ড কো স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিল মাত্র ৩,৪১২ জন দর্শক। চেলসি ও লস অ্যাঞ্জেলেসের মধ্যে ম্যাচে উপস্থিত হয়েছিলেন ২২১৩৭ জন দর্শক। অথচ আটলান্টারমার্সিডিজ-বেঞ্জ স্টেডিয়ামটি ছিল ৭১ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন।
নকআউট পর্ব শুরুর আগে গত বৃহস্পতিবার ফিফা জানায়, ক্লাব বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে গড় উপস্থিতি ছিল ৩৪ হাজার ৭৭৩ জন। দর্শক উপস্থিতিতে কেন এমন পরিস্থিতি এবার ক্লাব বিশ্বকাপে? কেন দর্শকরা খুব বেশি সাড়া দেয়নি ফিফার নতুন ডিজাইন করা নতুন এই বিশ্বকাপ ঘিরে?
এর কিছু কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হলো...
অর্থনৈতিক চাপ ও টিকিটের মূল্য
ইএসপিএন-এর প্রতিবেদন অনুসারে, টিকিটের উচ্চ মূল্য এবং ‘ডায়নামিক প্রাইসিং’ পদ্ধতি দর্শকদের স্টেডিয়ামে আসতে নিরুৎসাহিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, চেলসি-এলএএফসি ম্যাচের টিকিটের দাম শুরুতে ৮৩ ডলার থেকে কমে ৫১ ডলারে নেমে আসে, কারণ অনেকে শেষ মুহূর্তে সস্তা টিকিটের জন্য অপেক্ষা করছেন।
আমেরিকান আউটলজ, ইউএসএমএনটি সমর্থক গ্রুপের নেতা ট্রেভিন উর্ম বলেন, ‘গোল্ড কাপের মতো ইভেন্টে টিকিটের দাম অনেক বেশি। অর্থনৈতিক চাপের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য এই খরচ বহন করা কঠিন।’
অতিমাত্রায় ফুটবল ম্যাচ
এই কম দর্শক উপস্থিতির জন্য আরেকটি বড় কারণ হলো ফুটবলের ‘অতিমাত্রায় পরিপূর্ণতা’। একই সময়ে ক্লাব বিশ্বকাপ এবং কনকাকাফ গোল্ড কাপের মতো বড় দুটি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হওয়ায় দর্শকদের মনোযোগ বিভক্ত হয়ে গেছে। আমেরিকান আউটলজের অপারেশন সহকারী হুইটনি জালেস্কি বলেন, ‘এত বেশি ফুটবল চলছে, যা খারাপ নয়, তবে এটি এখনকার বাস্তবতা।’
ফিফার পরিকল্পনার ত্রুটি
ফিফা সূত্র জানায়, সম্প্রচার স্বত্ত্ব এবং পুরস্কারের অর্থ নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে খেলা আয়োজনের পরিকল্পনায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। টিকিট বিক্রির প্রচারে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট থাকলেও পরিষ্কার লক্ষ্য ও পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে তা কার্যকর হয়নি। এছাড়া, ফিফা এর আগে কখনো একই সময়ে গোল্ডকাপের মতো আরেকটি বড় টুর্নামেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেনি, যা পরিকল্পনার জটিলতা বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র দলের পারফরম্যান্স
যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষ জাতীয় ফুটবল দল (ইউএসএমএনটি) সম্প্রতি ঘরের মাঠে টানা চারটি ম্যাচ হেরেছে, যা স্থানীয় দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। তবে, ট্রেভিন উর্ম মনে করেন, দলের ফর্মের চেয়ে অর্থনৈতিক বিষয় এবং ফুটবলের অতিরিক্ত ম্যাচই এই পরিস্থিতির জন্য বেশি দায়ী।
ক্লাব বিশ্বকাপের আকর্ষণের অভাব
ক্লাব বিশ্বকাপে ম্যানচেস্টার সিটি, রিয়াল মাদ্রিদ, বোটাফোগোর মতো বড় দল থাকলেও, এটি ফিফার প্রধান বিশ্বকাপের মতো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা আকর্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। ফিফা এবং কনকাকাফের প্রত্যাশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াপ্রেমীরা বড় দলগুলো দেখতে স্টেডিয়ামে ভিড় করবেন; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ২০২৬ বিশ্বকাপের আগে এই টুর্নামেন্টগুলো একটি ‘প্রস্তুতি’ হিসেবে দেখা হলেও, দর্শকদের উপস্থিতি বাড়াতে ফিফাকে আরও কার্যকর পরিকল্পনা করতে হবে।
ফুটবলের এই গ্রীষ্মকালীন উৎসবে দর্শকদের কম উপস্থিতি ফিফা এবং কনকাকাফের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। টিকিটের দাম কমানো, প্রচারণা জোরদার করা এবং একই সময়ে একাধিক বড় টুর্নামেন্ট এড়ানোর মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ফুটবলপ্রেমীদের উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে এবং স্টেডিয়ামগুলো পূর্ণ করতে আরও সময় এবং পরিকল্পনার প্রয়োজন।
আইএইচএস/