ফিরে দেখা ২০২৫

নারী ফুটবল: টেবিলে বিদ্রোহ, মাঠে ইতিহাস

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:৪২ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

৩০ জানুয়ারি ২০২৫। এ দিনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঘটে যায় নজিরবিহীন এক ঘটনা। দেশের শীর্ষ ১৮ নারী ফুটবলার সংবাদ মাধ্যমকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন পিটার বাটলার কোচ থাকলে তারা আর খেলবেন না।

বেতন, ভাতাসহ নানা বিষয়ে ক্রীড়াঙ্গনে টানাপোড়েনের উদাহরণ আছে। দাবি-দাওয়া নিয়ে অনুশীলন বর্জনের মতো ঘটনাও নতুন নয়। তবে খেলোয়াড়রা জোট বেঁধে সরাসরি কোচ তাড়ানোর মিশনে নামার ঘটনা আগে বাংলাদেশের কোনো খেলায় এভাবে দেখা যায়নি।

বিদায়ী ২০২৫ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সাবিনা, কৃষ্ণা, মাসুরা, সানজিদা, ঋতুপর্ণা, মারিয়া, মনিকাসহ ১৮ সিনিয়র ফুটবলারের কোচের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ঘোষণা।

নারী ফুটবলাররা যখন এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার মাত্র ৩ মাস আগে দ্বিতীয়বার সাফ জিতেছিল বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের জন্য ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, টুর্নামেন্টের শুরুতেই কোচ-খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে।

গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিনিয়রদের বাইরে রেখে দল গড়েছিলেন পিটার বাটলার। হারতে বসেছিলেন প্রায়। কোনোমতে ড্র করে মেয়েরা ভারতের বিপক্ষে নিজেরাই দল তৈরি করে মাঠে নেমে দাপুটে জয়ে টিকেছিল টুর্নামেন্টে এবং শেষ পর্যন্ত হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।

কাঠমান্ডুর ওই ঘটনার পানি দেশে এসে অনেক গড়ানোর পর সাবিনারা সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সবার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, নারী ফুটবল আবার শেষ না হয়ে যায়! তবে শীর্ষ ১৮ ফুটবলার বাদ দিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন পিটার। তিনি কারো কথাই শুনছিলেন না। শৃঙ্খলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তরুণ্যনির্ভর দল তৈরি করে ফেব্রুয়ারি মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে যান পিটার বাটলার।

স্বাগতিক মেয়েদের কাছে দুই ম্যাচে ৫ গোল খাওয়ার পর আরো শঙ্কা তৈরি হয় নারী ফুটবলের ভবিষ্যত নিয়ে। বাস্তবতা মেনে পিটার বাটলার মে মাসে জর্ডান সফরের আগে বিদ্রোহীদের ৫ জন বাদে বাকিদের ফিরিয়ে আনেন। কারণ, জুন-জুলাইয়ে ছিল পিটার বাটলারের বড় চ্যালেঞ্জ এএফসি এশিয়ান কাপ
বাছাই।

নারী ফুটবল: টেবিলে বিদ্রোহ, মাঠে ইতিহাস

জাতীয় দলের মিয়ানমার জয়
জুনে মিয়ানমারে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রথম ম্যাচে বাহরাইনকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে যেন নতুন শুরু হয় বাংলাদেশের মেয়েদের। পরের ম্যাচে ঋতুপর্ণার জাদুতে বাংলাদেশ ২-১ গোলে হারায় শক্তিশালী মিয়ানমারকে। শেষ ম্যাচে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে জয় ৭-০ গোলে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এএফসি নারী এশিয়ান কাপে খেলার টিকিট নিশ্চিত করে ইয়াংগুনের মাটিতে।

এরপর অনূর্ধ্ব-২০ দলও এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্ব টপকিয়ে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচ হয়েছিল লাওসে। স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে হারিয়ে বাছাই শুরু করেছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। দ্বিতীয় ম্যাচে পূর্ব তিমুরকে হারিয়েছিল ৮-০ গোলে। তাতেই বাংলাদেশের চূড়ান্ত পর্বে ওঠা নিশ্চিত হয়েছিল। শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে বাংলাদেশ হেরে যায় ৬-১ গোলে।

সিনিয়রা ইতিহাস গড়েছিলেন মিয়ানমারের মাটিতে, যুবতীরা লাওসে। সবকিছু মিলিয়ে নারী ফুটবলে শতভাগ সাফল্যে টইটুম্বুর ছিল ২০২৫ সালটি।

মাত্র পনের বছর আগে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হওয়া বাংলাদেশের নারী ফুটবল দক্ষিণ এশিয়া শাসন করে এখন পদার্পণ করেছে এশিয়ার গন্ডিতে। এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেওয়ার পর নারী ফুটবল দলের সামনে আছে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক ফুটবলেরও হাতছানি। সিনিয়র ও অনূর্ধ্ব-২০ মিলিয়ে এ বছর বাংলাদেশ ২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। সিনিয়র দল এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করেছে, অনূর্ধ্ব-২০ দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ও এশিয়ান কাপে উঠেছে।

নারী ফুটবল: টেবিলে বিদ্রোহ, মাঠে ইতিহাস

বাংলাদেশ জাতীয় ও অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবল দলের কোচ পিটার বাটলার ও অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার। খেলোয়াড়দের একটা বড় অংশ দুই দলেরই সদস্য। দুটি দলের অনুশীলন পরিকল্পনা একই সাথে সাজিয়ে থাকেন পিটার। এত বড় একটা বিদ্রোহের পর নারী ফুটবলের এমন সাফল্য উল্লেখ করার মতো ঘটনাই। বিশেষ করে সিনিয়র কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে দলের বাইরে রেখে। বিদ্রোহের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। টেবিলের বিদ্রোহে ছাপিয়ে মাঠে ইতিহাস গড়েছেন আফঈদা-ঋতুপর্ণারা।

জাতীয় দলের বছরটা শুরু হয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর দিয়ে। ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ে গিয়ে বাংলাদেশ দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল স্বাগতিকদের বিপক্ষে। প্রথমটি হেরেছিল ২-১ গোলে ও দ্বিতীয়টি ৩-১ গোলে। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ আরো দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলে। মে-জুনে জর্ডানের আম্মানে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে এবং দ্বিতীয় ম্যাচে ২-২ গোলে জর্ডানের বিপক্ষে ড্র করে।

এই চার ম্যাচের প্রস্তুতি নিয়েই ঋতুপর্ণা-আফঈদারা জুন-জুলাইয়ে মিয়ানমারে অংশ নেন এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে। স্বাগতিক মিয়ানমার ছাড়াও বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল বাহরাইন ও তুর্কমেনিস্তান। বাংলাদেশ গ্রুপসেরা হয়ে উঠে যায় এশিয়ান কাপে। নতুন ইতিহাস রচিত হয় দেশের ফুটবলে।

বিদায়ী বছর সিনিয়র নারী ফুটবল দল ১১টি ম্যাচ খেলেছে। পুরুষ জাতীয় দলের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন নারী জাতীয় দলের ফুটবলারা। নারী ফুটবলাররা এশিয়ান কাপে খেলার লক্ষ্য অর্জন করলেও পুরো বছরে খেলা ম্যাচগুলোতে জয়ের হার কম। এই যেমন ১১ ম্যাচের মধ্যে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তিনটি ম্যাচই জিততে পেরেছে বাংলাদেশ। বাকি ৮ ম্যাচের ৬টিই হেরেছে। দুটি ড্র করেছে।

এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের পর বাংলাদেশ চারটি ম্যাচ খেলে সবকটিই হেরেছে। ঋতুপর্ণারা প্রীতি ম্যাচ খেলতে থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন অক্টোবরে। এই সফরটা বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকবে। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা দুই ম্যাচের একটি হেরেছে ৩-০ ও অন্যটি ৫-১ গোলে।

নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাফুফে ঢাকায় আয়োজন করেছিল ত্রিদেশীয় কাপ। অন্য দুই দল মালয়েশিয়া ও আজারবাইজান। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ১-০ গোলে হেরে যায় মালয়েশিয়ার কাছে। দ্বিতীয় ম্যাচে আজারবাইজানের বিপক্ষে জয় ২-১ গোলে। এই ম্যাচ দিয়ে ইউরোপের কোনো দেশের বিপক্ষে অভিষেক হয় বাংলাদেশের।

নারী ফুটবল: টেবিলে বিদ্রোহ, মাঠে ইতিহাস

বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে অনূর্ধ্ব-২০ দলও
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিদায়ী ২০২৫ সালে দেশের ফুটবল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোড়া সাফল্য দেখেছে মেয়েদের কল্যাণে। নারী জাতীয় দলের পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-২০ দলও ইতিহাস গড়েছে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে।

আগামী বছর এপ্রিলে থাইল্যান্ডে বসবে এএফসি নারী অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপের আসর। বাংলাদেশ সেই সেরা ১২ দলের একটি। অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের বাংলাদেশের গ্রুপের খেলা হয়েছিল লাওসে। স্বাগতিকরা ছাড়াও বাংলাদেশ গ্রুপে ছিল পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। বাংলাদেশ লাওসকে ১-০ ও পূর্ব তিমুরকে ৮-০ গোলে হারানোর পর শেষ ম্যাচে ৬-১ গোলে হেরে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে।

তবে তাতেও আটকানো যায়নি বাংলাদেশের মেয়েদের এশিয়ান কাপে ওঠা। লাওসে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে অংশ নেওয়ার আগে অনূর্ধ্ব-২০ দল ঢাকায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়। ঘরের মাঠে বাংলাদেশের মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ার অনূর্ধ্ব-২০ বয়সের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়।

সবমিলিয়ে মেয়েরা ২০২৫ সালে তিনটি আসরে বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেন। নারী জাতীয় ও অনূর্ধ্ব-২০ দলের খেলোয়াড়দের অনেকেই কমন। কোচ পিটার বাটলার ও অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার দুই দলেরই নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। নারী ফুটবলের এই যে ইতিহাস রচিত হয়েছে সেখানে এই দুইজনও জায়গা করে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।

নতুন বছরে নারী ফুটবলাররা অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান কাপে ও থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য এএফসি অনূর্ধ-২০ এশিয়া কাপে ভালো কিছু করতে পারলে বিদায়ী বছরের সাফল্যের ধারাও বজায় থাকবে।

আরআই/এমএমআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।