শাহেন শাহের উদ্ভাবন
ড্রোনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সচল রাখার পদ্ধতি

ভূমিকম্প, বন্যা, পাহাড় ধসসহ যে কোনো দুর্যোগে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে উদ্ধার কাজ ব্যহত হয়। বাড়ে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এ ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে তুরস্কের ইলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহেন শাহ ড্রোনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সচল রাখার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। যা তুরস্কের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হুরিয়াত, ইংরেজি দৈনিক সাবাহ, প্রধান টিভি চ্যানেল টিআরটি হাবের গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছে।
বাংলাদেশের সন্তান শাহেন শাহের এ সাড়া জাগানো উদ্ভাবন নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান—
ছোটবেলা থেকেই
ছোটবেলায় যখন বিজ্ঞান বই পড়তেন; তখন শাহেন শাহ ভাবতেন বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবেন। অনেক কিছু আবিষ্কার করবেন। যা মানুষের কল্যাণে যুগের পর যুগ ব্যবহার হবে। ছোট শাহেন শাহের এ ভাবনা যেন বড়বেলায় সত্যি হয়েই ধরা দিলো। তার ছোটবেলায়ই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা ছিল। যেটি তিনি সত্যি সত্যি পূরণ করেছেন। শাহেন শাহের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরে। বাবা ছিলেন আইনজীবী। পরিবার নিয়ে তিনি তুরস্কে বসবাস করছেন গত দশ বছর ধরে।
উদ্ভাবনের গল্প
২০২২ সালে শাহেন শাহ কাজ শুরু করেন। তিনি চাইতেন এমন কিছু উদ্ভাবন করতে, যা অসংখ্য মানুষের উপকারে আসবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পে প্রচুর মানুষ মারা যায়। খোদ তুরস্কেই ভূমিকম্প কেড়ে নেয় হাজারো প্রাণ। বিষয়গুলো শাহেন শাহকে নেটওয়ার্ট সচল রাখার উদ্ভাবনে উৎসাহিত করে। তার এ উদ্ভাবন বিখ্যাত ড্রোনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। শাহেন শাহের উদ্ভাবন তুরস্কের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা পরিষদ এবং ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পে প্রাথমিক সফলতার মুখ দেখেছে। এখন এটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। শাহেন শাহের সাথে আরও ৯ জন যুক্ত আছেন। যারা তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং পিএইচডিতে অধ্যায়নরত।
কীভাবে কাজ করে
দুর্যোগে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি। যেখানে দুর্যোগ হবে; সেখানে কিছু ড্রোন নির্দিষ্ট দূরত্বে আকাশে উড়বে। তারা নিজেদের মধ্যে কানেক্ট হবে। ড্রোনগুলো একটি বেজ স্টেশনের মতো কাজ করবে। ভূপৃষ্টে যারা থাকবেন; তাদের নেটওয়ার্ক সুবিধা দেবে। অনেকটা ওয়াইফাইয়ের মতো। এটাই হলো তার উদ্ভাবনের কাজের প্রক্রিয়া।
যত চ্যালেঞ্জ
যে কোনো উদ্ভাবন বাস্তবায়ন করতে গিয়েই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। সেইসব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলার পরেই সত্যিকারের সফলতার দেখা মেলে। ইক্যুইপমেন্ট, ডিজাইন, এআই অটোমেশন, একটি দেশ বা জায়গা কভার করতে কতগুলো ড্রোন লাগবে; সেটি ঠিক করা—এমন অনেক কিছু নিয়ে সমস্যার মুখে পড়েছেন শাহেন শাহ। তবে বুদ্ধি করে ঠিকই সমাধান বের করে নিয়েছেন। শাহেন শাহ বলেন, ‘তুরস্ক সরকার তার গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে গুরুত্ব সহকারে দেখছে।’
বাংলাদেশেও ব্যবহার সম্ভব
বাংলাদেশে প্রায়াই বন্যা হয়। গত বছর বন্যায় লক্ষ্মীপুর, ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। পুরো নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছিল। এমন অবস্থায় শাহেন শাহের উদ্ভাবন কাজে লাগানো সম্ভব। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার উদ্ভাবিত নেটওয়ার্ক সচল রাখার ব্যবস্থা কার্যকর করা যাবে। এ জন্য বাড়তি কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।’
- আরও পড়ুন
- ১৮০ কোটি টাকার চীনা বিনিয়োগ পেলো দেশি স্টার্টআপ ফাস্ট পাওয়ার টেক
- প্রযুক্তির উৎকর্ষে ঈদ আনন্দে ছন্দপতন!
যেভাবে তুরস্ক গেলেন
২০০৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন শাহেন শাহ। বাংলাদেশের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ইন আইটি এবং বুয়েট থেকে এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ইন আইসিটিতে মাস্টার্স করেন। ২০১৫ সালে তুরস্কের সরকারি বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে পাড়ি জমান ইস্তাম্বুলের ইলদিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাঝে দুটি ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন।
আনন্দ-বেদনার গল্প
ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু করার জন্য প্রবল আগ্রহ শাহেন শাহের। তাতে আসুক যত সমস্যা আর জটিলতা। এসব তিনি একদমই ভয় পাননি। এ জন্য জটিল কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারলে তার খুব ভালো লাগে। একটি আবিষ্কার যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে কাজের জন্য উপযুক্ত হয়; তখন তার আনন্দ দেখে কে? অন্যদিকে ড্রোন যখন সেন্সর জনিত সমস্যার জন্য হুট করে মাটিতে আছড়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তখন তার মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। কারণ গবেষণার জন্য টাকা তো একবারই পাওয়া যায়। অবশ্য গবেষণায় পকেটের টাকা থেকে বিভিন্ন খরচ করেছেন, এমন অনেক ঘটনাই আছে তার জীবনে। গবেষণায় সফল হওয়াটাই তার কাছে সবচেয়ে মুখ্য।
বুকে বাংলাদেশ
শাহেন শাহ তুরস্কের নাগরিক। তাই বলে বাংলাদেশকে তিনি ভুলে যাননি। দেশের প্রয়োজনে যদি কাজ করার সুযোগ হয়। তাহলে অবশ্যই তিনি তা করতে একটুও বিলম্ব করবেন না বলে জানান।
স্বীকৃতি ও অর্জন
শাহেন শাহের অন্যতম আবিষ্কার চালকবিহীন গাড়ি। চালক ছাড়াই অন্য সব গাড়ির মাঝে এ গাড়ি দিব্যি চলতে পারে। তার এ কাজে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যোগাযোগের বিলম্বের শর্ত পূরণ করতে পারা ও সময়টা কমিয়ে নিয়ে আসা। এ বিলম্বটাই ১০০ মিলি সেকেন্ডে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি। এ কাজের জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। যা ২০২১ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনোভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশনে (আইটেক্স) প্রদান করা হয়। গবেষক হিসেবে শাহেন শাহের নাম স্থান পেয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ২ শতাংশ গবেষকের নামের তালিকায়। ২০২৩ সাল থেকে আজ অবধি এ তালিকায় নাম আছে তার। গবেষণার সাইটেশন সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা তৈরি করে স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড এলসেভিয়ের। বর্তমানে তিনি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইইই) জ্যেষ্ঠ সদস্য।
নতুন গবেষকদের জন্য
কোনো বিষয়ে গবেষণা করলে বেশি আয় করা যাবে। বেশি জনপ্রিয় হওয়া যাবে। নতুন গবেষকদের মধ্যে এমন একটি ঝোঁক দেখা যায়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে শাহেন শাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘নিজের যেটা পছন্দ, নিজের যেটা ভালো লাগে; সেটা নিয়ে কাজ করা উচিত। তাহলে লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়।’
আগামীর ভাবনা
শাহেন শাহ এমন অনেক কিছু আবিষ্কার করতে চান, যার দ্বারা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ উপকৃত হবেন। তিনি তার আবিষ্কারগুলো যেন বাস্তবে ব্যবহার করা যায়, সে পর্যায়ে নিয়ে রেখে যেতে চান।
এসইউ/জিকেএস