ফিনল্যান্ডের হাংকো

সমুদ্রতীরের নৈঃশব্দ্য ও স্মৃতির শহর

তানভীর অপু
তানভীর অপু তানভীর অপু , বিশ্ব পর্যটক
প্রকাশিত: ০২:২৫ পিএম, ০৫ জুলাই ২০২৫

সমুদ্রের নীল যেখানে মিশেছে সূর্যালোকের মৃদু উষ্ণতায়। যেখানে বালুকাবেলায় খেলে যায় বাতাসের নরম সুর—সেই শান্ত শহরের নাম হাংকো। ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে, বাল্টিক সাগরের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহরটি যেন প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক নিভৃত উপাখ্যান। রাজধানী হেলসিংকি থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরের এ শান্ত শহর আমার ভ্রমণপথে ফিরে এসেছিল অনেক বছর পর—একটি পূর্ণচক্রের মতো।

প্রথম এসেছিলাম এখানে ২০০৬ সালে। তখনো হাংকো ছিল সমুদ্রপথের আমার প্রথম জানালা—এ শহর থেকেই জাহাজে করে আমি জার্মানির দিকে পাড়ি দিই। সেই স্মৃতি আজও মনে গাঁথা। বহুদিন পর, ঠিক যেন এক পুরোনো চিঠির মতো আবার ফিরলাম এ শহরে। হাংকো এখনো ঠিক আগের মতোই নিঃশব্দ, গাম্ভীর্যপূর্ণ, অথচ হৃদয়ভরা আমন্ত্রণে ভরপুর।

হাংকো একদিকে সাগরের দিকে প্রসারিত উপদ্বীপ; অন্যদিকে জুড়ে আছে সবুজ বনাঞ্চল, ফুলে-ফলে ভরা রঙিন রাস্তা আর ঐতিহাসিক ভবন। তিনদিক দিয়ে বাল্টিক সাগর বেষ্টিত এ শহর যেন প্রকৃতির আঁচলে মোড়ানো স্বপ্নের দেশ। ফিনল্যান্ডের গ্রীষ্মকালে হাংকো সবচেয়ে বেশি সূর্যের আলো পায়। তাই এখানকার দিনগুলো হয় দীর্ঘ ও উজ্জ্বল।

সমুদ্রতীরের নৈঃশব্দ্য ও স্মৃতির শহর

বিভিন্ন রঙের ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে শহরের প্রতিটি কোণ। মনে হয় যেন কেউ স্বপ্নের তুলিতে শহরটিকে একদিনে এঁকে দিয়েছে। উপকূল ঘেঁষে আছে সুসজ্জিত স্পিড বোট ঘাট—ফিনল্যান্ডের ধনীদের দামি স্পিড বোটগুলো এখানে ভিড়ে থাকে। আবার বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেও আসেন বোটপ্রেমীরা। কেউ এখানে অল্প ক’দিনের জন্য থাকেন, কেউ শুধুই সূর্যাস্ত দেখতে নোঙর ফেলেন।

১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শহরটির আছে গর্ব করার মতো অতীত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাংকো কৌশলগতভাবে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাময়িক দখলেও চলে যায় (১৯৪০–১৯৪১)। আজও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে সেই যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন—রণাঙ্গন, জাদুঘর, ট্যাঙ্ক মিউজিয়াম যেন সময়ের দর্পণে বন্দি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

পুরোনো কাঠের তৈরি বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এ শহরের শেকড় কত গভীরে প্রোথিত। এ শহরের স্পা পার্কে থাকা পুরাতন ভিলাগুলোর স্থাপত্যশৈলী—রাশিয়ান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রীতির মিশ্রণে তৈরি—আমার মনে বারবার উসকে দিয়েছে এক অতীতমুগ্ধতা।

সমুদ্রতীরের নৈঃশব্দ্য ও স্মৃতির শহর

আরও পড়ুন

হাংকোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নিঃসন্দেহে এর বালুকাময় সমুদ্রতট—হাংকো বিচ। ফিনল্যান্ডের দীর্ঘতম বালুকাবেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। গ্রীষ্মে এখানে সূর্যস্নান, সাঁতার, ওয়াটার স্পোর্টস—সবই চলে রীতিমতো উৎসবের মতো। আমি যখন এসেছিলাম; তখন শহরটি পর্যটকে গমগম করছিল। সমুদ্রের নীল জলরেখা ছুঁয়ে ছুটে চলছিল বাচ্চারা আর জেটস্কি ও কায়াকের শব্দ মিলেমিশে এক আনন্দময় সুর তুলেছিল বাতাসে।

এ ছাড়া হাংকো ওয়াটার টাওয়ার—শহরের সর্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা এক জলাধার—যেখান থেকে পুরো শহর, সমুদ্র ও নিকটবর্তী দ্বীপগুলো দেখা যায় পাখির চোখে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে দেখেছি সেই দৃশ্য—নীল সাগরের বুক চিরে যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, মনে হয়েছিল সময়টা যেন থেমে গেছে!

হাংকো দ্বিভাষিক শহর—এখানে ফিনিশ ও সুইডিশ ভাষা পাশাপাশি চলে। মানুষজন অত্যন্ত ভদ্র, পরিশীলিত এবং অতিথিপরায়ণ। গ্রীষ্মে প্রতি বছর আয়োজিত হয় বিখ্যাত হাংকো রেগাট্টা—পালতোলা নৌকার প্রতিযোগিতা ও উৎসব। যেখানে সারাদেশ এমনকি বিদেশ থেকেও লোকজন আসে। এটি শুধু ক্রীড়ার আসরই নয় বরং এক বৃহৎ সামাজিক মিলনমেলাও।

সমুদ্রতীরের নৈঃশব্দ্য ও স্মৃতির শহর

হাংকো শুধু একটি শহর নয়, এক জীবন্ত স্মৃতি। সময়ের সাথে সাথে শহরের রূপ কিছুটা বদলালেও তার আত্মা রয়ে গেছে আগের মতোই। ফিরে এসে আমি আবার খুঁজে পেয়েছি সেই পুরোনো বন্দর, সেই সমুদ্রের গন্ধ, সেই সূর্যাস্তের রং। হাংকো যেন আমার ভ্রমণজীবনের এক নীরব আশ্রয়—যেখানে প্রত্যাবর্তন মানে শুধুই ভ্রমণ নয় বরং নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা।

আপনি যদি কোনো এক গ্রীষ্মে শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন, তবে হাংকো শহর আপনাকে ডাকবে নিঃশব্দে—সমুদ্রের গানে, সূর্যাস্তের আলোয়। অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু সাইফুল ইসলাম রিংকুকে, আমাকে নিয়ে চমৎকার শহরটি ভ্রমণ করার জন্য।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।