বর্ষায় বান্দরবান ভ্রমণে ঘুরবেন যেসব স্পট
রুবেল মিয়া নাহিদ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান। অনেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ভারতের দার্জিলিং যান। তবে সৌন্দর্যের দিক থেকে বান্দরবান দার্জিলিং থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বান্দরবানে শুধু শীতকালেই বেড়াতে যাবেন এমন কোনো কথা নেই।
সেখানে বর্ষাকালে বেশি মেঘ দেখা যায়। সারা বছরই পর্যটকরা সেখানে ভিড় করে। এই লেখায় বান্দরবান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, পর্যটন স্পট, থাকা খাওয়া, খরচ ইত্যাদি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পাবেন।
রাতে আমরা কল্যাণপুর থেকে রওনা হই। বান্দরবান শহরে পৌঁছতে সকাল ৭টা বেজে যায়। শহরে থাকার মতো অনেক হোটেল আছে। ভাড়া হাতের নাগালে। আমরা মাঝারিমানের একটি হোটেলে উঠলাম। তিন জনের প্রতি রাতে ভাড়া ৬০০ টাকা। খাওয়ার জন্য ও মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট আছে।
২০০-৩০০ টাকার মধ্যে পেট পুড়ে খাওয়া যায়। যাই হোক হোটেলে ফ্রেশ হয়ে আমরা ৩টার মধ্যে বের হলাম শহরের আশপাশের স্পটগুলো দেখতে। শহরের পাশে দেখার মতো ৩টি স্পট আছে। স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা ও নীলাচল। এই তিন স্পটে যেতে আপনাকে একটি বেবি ট্যাক্সি রিজার্ভ করতে হবে। ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা।
স্বর্ণ মন্দিরটি বৌদ্ধদের তীর্থস্থান। সেখানে ৫ শতাব্দি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে তৈরিকৃত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বৌদ্ধ মূতি আছে। মন্দিরটি ওখানকার বৌদ্ধরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। এটি দেখার মতো একটি প্রাচীন নিদর্শন। বৌদ্ধমন্দির থেকে চলে যেতে হবে মেঘলা।

ওখানে আছে দুটি ঝুলন্ত সেতু ও একটি ছোট চিড়িয়াখান। প্রবেশ ফি ১০ টাকা। তাছাড়া ওখানে পাহাড়েও হাঁটতে পারেন। পাহাড়ে ছোট ছোট দোকান পাবেন। দোকানে ডাব, কমলা, জাম্বুরা, পানি ইত্যাদি পাবেন। মেঘলা থেকে সোজা চলে যাবেন নীলাচল।
বেবিতে করে উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে যেতে হয় ওখানে। এই রাস্তা দিয়ে যেতে মনে অনেক ভয় ভয় লাগে। রাস্তায় যানবহন প্রতি চাঁদা দিতে হয় ২০ টাকা, আর নীলাচলে ঢোকার টিকিট মাথাপিছু ৫ টাকা।
নীলাচলের সৌন্দর্য ব্যক্ত করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। তারপরও চেষ্টা করছি। আপনি যেখানে দাড়িয়ে থাকবেন তা সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট উপরে। চারদিকে ছোট-বড় পাহাড় থরে থরে সুসজ্জিত। যারা মাইক্রোসফটের মোটর রেস গেমটি খেলেছেন তার কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
সেখান থেকে সূর্যাস্তটা মারাত্মক লাগে। আপনি যদি প্রথমেই নীলাচল চলে আসেন ও পরে মেঘলা ও স্বর্ণমন্দির যান তবে কিন্তু সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন না। তাই আগে অন্য দুটি স্পট শেষ করে এখানে আসবেন। আপনার ভাগ্য ভালো থাকলে এখানে পেয়ে যেতে পারেন মেঘ।

পরের দিন টার্গেট শৈলপ্রপাত, চিম্বুক ও নীলগিরি। আগেই বলে নিচ্ছি বান্দরবান ভ্রমণের সময় ৮-১০ জনের একটি টিম নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। সকালে নাস্তা সেরে আমরা জলপ্রাপাত, চিম্বুক ও নীলগিরির উদ্দেশ্যে রওনা হই।
বান্দরবান শহর থেকে এদের দূরত্ব যথাক্রমে ৮, ২৬ ও ৪৪ কিলোমিটার। শহর থেকে জিপ ভাড়া নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। ভাড়া ২৩০০-২৬০০ টাকা। নীলগিরিতে পার্কিং চার্জ মাত্র ২০০ টাকা।
সেখানে সাধারণত ভোরবেলায় মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আপনি দাঁড়িয়ে থাববেন। আপনার চারদিকে থাকবে শুধু মেঘ আর মেঘ। মনে হবে আপনি সমুদ্রে দাড়িয়ে আছে।
চিম্বুক পাহাড়ে দেখার মত কিছুই নেই। তবে মেঘ যদি পাওয় যায় তবে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নেই। শৈল প্রপাতের বিশাল ঝর্ণা আপনাকে বিমোহিত করবেই। অনবরত বারিধারা প্রতিনিয়ত ঝড়েই যাচ্ছে।

সেখানকার অধিবাসীরা এই পানিতে গোসল করে ও এখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে। আপনি চাইলে সেখানে অবগাহন করে নিজের দেহ ও মন দুটোই প্রস্ফুটিত করতে পারেন।
নীলগিরিতে রাতযাপনের জন্য সেনাবাহিনী পরিচালিত মেঘদূত, আকাশনীলা, নীলাঙ্গনা, হেতকরা রাইচা, মারমা রাইচা নামের আকর্ষণীয় কয়েকটি কটেজ আছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এসব কটেজে অবস্থান ও রাতযাপনের জন্য সেনাবাহিনীর বান্দরবান ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করতে হয়।
ভাড়া ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভাড়া একটু বেশি পড়লেও এতে থাকার মজাই আলাদা। তবে চিন্তা নেই আমরা সেখানে থাকিনি।
বান্দরবান জেলায় দেখার মতো জায়গাগুলো হলো-
১। নীলগিরি ২। স্বর্ণমন্দির ৩। মেঘলা ৪। শৈল প্রপাত ৫। নীলাচল ৬। মিলনছড়ি ৭। চিম্বুক ৮। সাঙ্গু নদী ৯। তাজিনডং ১০। কেওক্রাডং ১১। জাদিপাই ঝরণা ১২। বগালেক ১৩। মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স ১৪। প্রান্তিক লেক ১৫। ঋজুক জলপ্রপাত ১৬। নাফাখুম জলপ্রপাত। এছাড়া বান্দরবানে কয়েকটি ঝিরি রয়েছে। যেমন- চিংড়ি ঝিরি, পাতাং ঝিরি, রুমানাপাড়া ঝিরি।
এতগুলো জায়গা একসঙ্গে দেখা সম্ভব নয়। তবে বান্দরবান শহরে থেকে, আশেপাশের ৭টি এলাকা- স্বর্ণ মন্দির, নীলগিরি, মেঘলা, নীলাচল, শৈল প্রপাত, মিলনছড়ি ও চিম্বুক ঘুরে আসতে পারেন।

বান্দরবানে কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সরাসরি আরামবাগ থেকে শ্যামলী, ঈগল, ইউনিক বাস সার্ভিস সরাসরি বান্দরবান যায়। ননএসি জনপ্রতি ভাড়া নিবে ৫৫০-৬৫০ টাকা ও এসি ভাড়া নিবে ৯৫০-১৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বান্দরবান যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে প্রতিদিনই সোনারবাংলা, মহানগর ইত্যাদি ট্রেন চট্টগ্রাম যায়। শ্রেণিভেদে ট্রেনের টিকিটের মূল্য ৩২০-১৫০০ টাকা। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে বান্দরবান যেতে পারবেন।
চট্টগ্রাম হয়ে বান্দরবান
দেশের যে কোনো এলাকা থেকে বান্দরবান যাওয়ার জন্য প্রথমে চট্টগ্রাম যেতে হবে। সেখানের বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে বাস-এ করে যেতে হবে বান্দরবান। বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে। প্রতি ৩০ মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন?
বান্দরবান সদরে বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। সেগুলো হলো- হোটেল ফোর স্টার, হোটেল গ্রিন হিল, হোটেল হিল বার্ড, হোটেল পূরবী, হোটেল প্লাজা ইত্যাদি। এছাড়া হোটেল থ্রি স্টার বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত।
নীলগিরির গাড়ি এই হোটেলের সামনে থেকে ছাড়ে। এই হোটেলের সুবিধা হল এখানের ৪ বেডের একটি ফ্ল্যাটে ৮ থেকে ১০ জন একসঙ্গে থাকতে পারে। পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান ভ্রমণ ও এর সৌন্দর্য উপভোগ করার করার ক্ষেত্রে অনেকে ভ্রমণ কম খরচের কথা ভাবে।

ভ্রমণ খরচ অনেকাংশেই ভ্রমণের সময় এবং ভ্রমণকারী কিভাবে খরচ করবে তার উপর নির্ভর করে। অনেকেই হয়তো খরচের চেয়ে আমরাই প্রাধান্য দেয়। আবার অনেকেই হয়তো হারানোর চেয়ে কম খরচে দিকেই প্রাধান্য দেয়।
সুতরাং খরচ নির্ভর করবে আপনার উপর। মোটামুটি ভাবে আপনি গেলে খরচ পড়তে পারে ৪০০০-৫০০০ এর ভেতর।
পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান ভ্রমণ ও কিছু সতর্কতা-
>> ভ্রমণে কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
>> পর্যটন এলাকায় প্রায় দালাল চক্রের উৎপাত দেখা যায় তাই সতর্ক থাকবেন।
>> পাহাড়ি এলাকাগুলো উঁচু-নিচু হয়, তাই বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
জেএমএস/জেআইএম