যৌতুক দিতে না পারায় নির্যাতিত হয়ে তারা এখন বাবার বাড়িতে

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: ০৪:৪৩ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০২১

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে প্রিয়া আক্তারের (২০) বসবাস লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চরমণ্ডল গ্রামে। বিয়ে নিয়ে প্রিয়ার হাজারো রঙিন স্বপ্ন ছিল। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর পাশের চররুহিতা গ্রামের রাসেল হোসেনের (২৭) সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

বিয়েতে স্বর্ণালংকার দেওয়াসহ পালকি সাজিয়ে স্থানীয়ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে মেহমানদারি করেছে প্রিয়ার পরিবার। তাদের সংসারে এখন এক বছর বয়সী রোহান নামে এক সন্তান রয়েছে।

প্রিয়ার স্বামী রাসেল বিদেশ গিয়ে পরিশোধ করার কথা বলে তার বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার এনে দিতে বলেন। সেই টাকা এনে দিলে গেল বছরের ২৭ জানুয়ারি তিনি বিদেশ যান। চলতি বছরের ১৬ মে রাসেল বিদেশ থেকে প্রিয়াকে ফোন করে বলেন, স্থানীয় বাজারে তিনি একটি দোকান নিতে চান। এ কারণে আরও তিন লাখ টাকা বাবার বাড়ি থেকে এনে প্রিয়া যেন তার শাশুড়ির হাতে দেন। এই টাকা এনে দিতে রাজি না হওয়ায় শাশুড়ি তাকে হত্যার চেষ্টা করেন।

খবর পেয়ে প্রিয়ার মা মিহিনুর ছুটে আসলে মেয়ের শ্বশুর-ভাসুরসহ অন্যরা তাকেও এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারেন। প্রিয়াকে জোর করে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ছেলেসহ তার ঠিকানা এখন বাবার বাড়ি।

১৭ বছর আগে তাহমিনা আক্তারের (৩৫) বিয়ে হয় জহির উদ্দিনের সঙ্গে (৪৫)। তাহমিনার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চরলরেঞ্চ এলাকায়, আর জহিরের বাড়ি সদর উপজেলার বিনোদধর্মপুর গ্রামে। আহাদ (১৩) ও অহনা (৬) তাদের সন্তান। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল এই দম্পতির সংসার।

Lakshmipur

এর এক পর্যায়ে দুই লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে জহির বিদেশ পাড়ি জমান। এরপর বিদেশ থেকে এসে তিনি গোপনে আরেকটি বিয়ে করেন। অশান্তির ঢেউ যেন তাদের ঘরে আছড়ে পড়ে। কারণে-অকারণে জহিরসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাহমিনাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন।

সবশেষ ৬ সেপ্টেম্বর ব্যবসা করার জন্য দুই লাখ টাকা লাগবে জানিয়ে বাবার বাড়ি থেকে তাহমিনাকে আনতে বলেন জহির। বাবার সামর্থ্য নেই জানালে পিটিয়ে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়, যৌতুক না দিলে তাকে ঘরে তোলা হবে না। প্রয়োজনে তিনি অন্যত্র বিয়ে করে আরও বেশি টাকা যৌতুক নেবেন।

প্রায় দেড় বছর আগে রায়পুরের বামনী গ্রামের শাহিনুর আক্তারের (২৫) বিয়ে হয় লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্ছানগর এলাকার আরমান আলী রতনের (৩১) সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই পৈত্রিক জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা এনে দিতে শাহিনুরকে চাপ দিতে থাকেন রতন।

শাহিনুরের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকে প্রতিদিনই এই টাকার জন্য চলে মানসিক নির্যাতন। সুখের কথা ভেবে এক লাখ টাকা এনেও দেন তিনি। আরমান সেই টাকা কোনো কাজে না লাগিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই অসামাজিক কাজে উড়িয়ে দেন। সবশেষ ১৮ আগস্ট আবারও টাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এসময় শাহিনুর আগের টাকা ফেরত চাইলে তাকে কিল-ঘুষি মেরে চুলের মুঠি ধরে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। পরে তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেওয়া হয়। এখন বাবার বাড়িতে আশ্রয় শাহিনুরের।

Lakshmipur

প্রিয়া, তাহমিনা ও শাহিনুরকে স্বামীর সংসারে কারণে-অকারণে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মারধর, নির্যাতন ও যৌতুক দাবির ঘটনায় এখন আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন তারা। নতুন জীবন তাদের অনেক বাস্তবতা শেখাচ্ছে। স্বামীর সংসার নিয়ে তাদের দীর্ঘশ্বাস যেন আকাশ সমান! তাদের কাছে, সেই জীবন ছিল এক বিভীষিকাময় কালো অধ্যায়।

এই প্রিয়া, তাহমিনা ও শাহিনুরদের মতো নির্যাতনের শিকার নারীরা এখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। তারা নিজেদের, সন্তান ও অনাগত দিনের ভাবনা থেকে আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন। লক্ষ্মীপুরে বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দেড় শতাধিক মামলা হয়। এছাড়া প্রভাবশালী মহলের রক্তচক্ষুসহ নানা কারণে অনেক ঘটনা সামনেই আসে না।

মামলাগুলো তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরকে। সবগুলোই যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলা। মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা ও লক্ষ্মীপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক সুলতানা জোবেদা খানম বলেন, মামলাগুলো তদন্ত করতে গেলে দেখা যায়, নারীরা কত বেশি অসহায়। যারা পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করেন, তাদের প্রতিদিনই সংগ্রাম করে চলতে হয়। একেকটি ঘটনা করুন ও বিভীষিকাময়।

গত ২৩ নভেম্বর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেছে, চলতি নভেম্বর মাসে ১১টি যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলার তদন্তে মাঠপর্যায়ে গিয়ে তারা তদন্ত করেছেন। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক কয়েকটি বাল্যবিয়ে রোধ করেছেন। নির্যাতিতদের একটি অংশ তাদের কার্যালয়ে এসে বিচার চান। তখন জেলা লিগ্যাল এইড ও থানা পুলিশের সহযোগিতার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিমাসেই আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়।

রায়পুর উপজেলার শায়েস্তানগর গ্রামের মঞ্জু বেগম জানান, তার স্বামী-শ্বশুরসহ পরিবারের সদস্যরা যৌতুকের ৩০ হাজার টাকার জন্য কিছুদিন পরপর চাপ দেন। বাবা-মার সংসারে সচ্ছলতা নেই, কোথায় পাবেন তিনি এই টাকা? এ কারণে মুখ বুঝে তাকে পরিবারে নির্যাতন সহ্য করতে হয়।

Lakshmipur

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জেলায় ১১৫টি মহিলা উন্নয়ন সংস্থা রয়েছে। প্রত্যেকটিতে ৩০ থেকে ৪০ জন করে সদস্য আছেন। প্রতিমাসেই তাদের উদ্যোগে গ্রামে-গ্রামে উঠান বৈঠক করা হয়। সেখানে স্বাবলম্বী হওয়া, নারীর ক্ষমতায়ন-অধিকার, বাল্যবিয়ে ও ইভটিজিং প্রতিরোধে সচেতনতামূলক আলোচনা হয়। পাশাপাশি বিনা খরচে অসহায় নির্যাতিত নারীদের আইনগত সহায়তা নিশ্চিতের জন্য লিগ্যাল এইডের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এতে নারীরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারী উন্নয়নে কাজ করা সমিতিগুলোর সভানেত্রীসহ দায়িত্বশীলরা কাজ করতে গিয়ে গ্রামে বিভিন্ন সময় হেনস্তার শিকার হন। সরকারিভাবে প্রতিটি সমিতির জন্য বছরে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এতে নিজেদের জমানো মূলধনসহ বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

সদর উপজেলার উত্তর টুমচর শাপলা কুড়ি মহিলা উন্নয়ন সংস্থার সভানেত্রী হাজেরা বেগম বলেন, জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। কষ্ট থেকেই নারী উন্নয়নে মাঠে নেমেছি। কাজ করতে গিয়ে নানা মতের মানুষের নানা কটু কথা কথা শুনতে হয়েছে। আমার সঙ্গে এখন ৩৫ জন নারী সদস্য রয়েছেন। মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে অসচ্ছল ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছি।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সুলতানা জোবেদা খানম বলেন, নারী ক্ষমতায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এটি আমাদের কাজের একটি অংশ। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল থেকে মাসে অন্তত ১২টি করে মামলা আমাদেরকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরেজমিনে গিয়ে আমরা তদন্ত করি।

এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।