এক হারিকেনের আলোয় ৬ ভাইবোন লেখাপড়া করেছি
হামিদা পারভীন। দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রোটেকশন অ্যান্ড ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার হিসেবে। যৌথ পরিবার থেকে উঠে আসা রাজবাড়ীর কৃতিসন্তান হামিদার ১৪ ভাই-বোনই নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেন তিনি। বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে পুলিশে চাকরি নিয়ে দেশের সেবা করবে। বাবার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন হামিদা। ২০০৩ সালে যোগ দেন পুলিশে। তিনি বিসিএস ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অংশ হিসেবে আইভোরিকোস্টে গিয়ে পেশাদারত্বের জন্য প্রশংসিত হন।
২০১৬ সালে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির পরই প্রোটেকশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান। সেখানে প্রথম নারী কর্মকর্তা হিসেবে তিন বছরে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় সব ভিআইপির নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তিনবার আইজিপি গুড সার্ভিস ব্যাজ ও ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকে (পিপিএম) ভূষিত হন। ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট থেকে তিনি উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছর অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ডিএমপির প্রোটেকশন অ্যান্ড ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ব্যক্তিগত ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে সরাসরি কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
জাগো নিউজ: ১৪ ভাইবোনের বড় পরিবার। সেখান থেকে আপনার উঠে আসা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল। আপনার গল্পটা শুনতে চাই…
হামিদা পারভীন: আমরা ১৪ ভাই-বোন একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। এছাড়া অন্য আত্মীয়-স্বজনও আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছেন। একজন আরেকজনের জন্য ছাড় দেওয়াসহ প্রত্যকটি ক্ষেত্রে আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি। আমরা বড় হয়েছি একজনের আরেকজনের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে। একসঙ্গে থাকতে যেয়ে প্রত্যেকটি বিষয় আমাদের কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। আমার ভালোলাগা, চাওয়া-পাওয়া কিংবা অনেক কিছু অব্যক্ত থেকে গেছে; যা আমি পরিস্থিতির কারণে বলতে পারিনি। বাবা-মায়ের শিক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে শুধু পড়ালেখায় করেছি।
আমার বড় ভাইবোন আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন আর ছোট ভাইবোন আমার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস (ত্যাগস্বীকার) করেছে। যে গল্পগুলো এখন অনেকের রূপকথার গল্প মনে হতে পারে। এরমধ্যে আমাদের বাসায় যখন বিদ্যুৎ আসেনি তখন একটি মাত্র হারিকেনের আলোয় আমরা পাঁচ-ছয়জন ভাইবোন একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। এই স্মৃতি আমি এখনো চোখ থেকে মুছে ফেলতে পারি না। পরিবারের সবার অবদানের জন্য আজ আমি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হামিদা পারভীন।
জাগো নিউজ: পুলিশে আসার পেছনের গল্প শুনতে চাই...
হামিদা পারভীন: পুলিশে আসবো এমন কোনো চিন্তা ছিল না। আমার বাবার অনুপ্রেরণায় আমি আমি সিভিল সার্ভিসে এসেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার স্বামী বাবার চাওয়াটা অনেক বেশি সম্মান করতেন। ছোটবেলা থেকে চ্যালেঞ্জিং পেশা পছন্দ করতাম। পুলিশে জয়েন করার পর আমার মা মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার পেশা প্রতিদিন গর্ব উপভোগ করেছেন। পুলিশের ইউনিফর্ম পরলে আমার মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন। আমার বডিগার্ড-গাড়িচালক নিয়ে চলাফেরা করেছি; আমার মা নিশ্চিন্ত থেকেছেন। আমার অপ্রাপ্তি-মনোকষ্ট হচ্ছে ১৯৯৯ সালে আমার বাবা মারা যান কিন্তু বাবার চাওয়া তিনি দেখে যেতে পারেননি। পুলিশের আসার পেছনে বাবা-মা, প্রত্যেকটি ভাইবোনসহ আমার স্বামী-সন্তানের অবদান অস্বীকার্য।
আমার মেয়েটি আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। একজন মা হিসেবে সন্তানকে যতটুকু সময় দেওয়ার কথা ছিল এই চাকরির কারণে আমি মেয়েটিকে ততটুকু সময় দিতে পারিনি। এতে আমার মেয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। সে গর্ব করে ভেবেছে তার মা অন্য মায়েদের থেকে একটু আলাদা, পোশাক পরে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: ভুক্তভোগী হওয়ার পর নারীরা থানায় অভিযোগ করতে ভয় পায়, তারা মনে করে থানায় গেলে আরও হয়রানির শিকার হতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য অসহায় নারীদের জন্য আপনার মন্তব্য কী?
হামিদা পারভীন: এখন প্রতিটি থানায় হেল্পডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে শুধু নারী পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে নারী ও শিশুদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদের অভিযোগ অনুযায়ী সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়াও পুলিশে অনেকগুলো ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার রয়েছে। সেখানেও নারী পুলিশ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশের প্রত্যক অফিসার বর্তমানে জেন্ডার সংবেদনশীল হয়েই ভুক্তভোগী নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যারা এখনো থানায় আসার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন তারা নিশ্চিত মনে থানায় আসুন, আপনাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে সেটিরও অভিযোগ জানাতে পারেন। এই বিষয়টি এখন বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সবসময় পাশে আছে।
জাগো নিউজ: আপনার মতো অন্য নারীরাও পুলিশ বাহিনীতে আসতে চায়। এ জন্য আপনার মেসেজ কী?
হামিদা পারভীন: পুলিশিং একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, আমরা যারা চ্যালেঞ্জ ভালোবাসি তারা অবশ্যই এই পেশাতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ছোটবেলায় অনেকেই হয়তো দূরত্বের কারণে পুলিশভীতি কাজ করতো। আমরা নারীরা পুলিশে যোগদানের পর এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি। আমরা অনেক বেশি সাপোর্ট পেয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন করেছেন এটি সারা পৃথিবীতে বিরল। আমরা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারিনি, পুলিশ সার্ভিসে এসে দেশের মানুষের জন্য খুব কাছ থেকে করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: পর্নোগ্রাফি অপরাধে অনেক নারী-শিশু না বুঝে পা বাড়াচ্ছেন। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হামিদা পারভীন: পর্নোগ্রাফি থেকে পরিত্রাণের উপায় একমাত্র সচেতনতা। বাচ্চারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অভিভাবকদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। একটি স্মার্টফোন বাচ্চার হাতে দিলে সে কোন কোন অ্যাপ ব্যবহার করতে পারবে এক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশনের মধ্যে রাখা উচিত। এছাড়া বন্ধুবান্ধব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। আমাদের সবার ধর্মীয় মূল্যবোধ জরুরি। কেউ যদি পর্নোগ্রাফি জাতীয় হয়রানির শিকার হয়েই যান সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথমত অভিভাবককে জানাবেন। এরপর নিকটস্থ থানা অথবা সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করবেন।
জাগো নিউজ: জাতিসংঘে বাংলাদেশি নারী পুলিশ সদস্যদের অংশগ্রহণ, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতে জাতিসংঘ মিশনে নারীদের অংশগ্রহণ কীভাবে দেখছেন?
হামিদা পারভীন: বাংলাদেশে নারী পুলিশের মূল গর্বের জায়গা জাতিসংঘে নারী পুলিশের অবদান। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন- ‘বাংলাদেশ পুলিশের নারীরা জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে অনেক বেশি ভালো কাজ করছে।’ এছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব বারংবার বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অবদান স্বীকার করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রত্যেকটি নারী পুলিশ সদস্যদের অবশ্যই কাজ করা উচিত। মিশনে বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা অন্যান্য দেশের পুলিশের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে। অনেক সময় অন্যান্য দেশের থেকেও ভালো পেশাদারিত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারি।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
হামিদা পারভীন: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবীর নারীদের জানাচ্ছি শুভেচ্ছা। আপনাকে এবং জাগো নিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
টিটি/বিএ/জিকেএস