একজন নিশাতের গল্প

অ্যাডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত। তার পরিচয় অনেক। তিনি একাধারে আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। এছাড়াও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত পাঠক নন্দিত সাপ্তাহিক ‘গতিপথ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। দাম্পত্য জীবনে নিশাত এক কন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী জাবেদ রহিম বিজন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি।
১৯৭৩ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের পুনিয়াউটের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নিশাত। তার পিতা মোমিনুল হক কিরণ ছিলেন একটি জুট মিলের এক্সপোর্ট অফিসার। নিশাতের মাতার নাম হোসনে আরা খানম। তার দাদা আবদুর রহমান খান পাকিস্তান আমলের পাটমন্ত্রী ছিলেন। সে কারণে তাদের পুনিয়াউটের বাড়িটি এখনো ‘মন্ত্রী বাড়ি’ হিসেবেই খ্যাত।
৬ বোনের মধ্যে তৃতীয় নিশাত। বাবা চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনি পরিবারের সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। ছেলে সন্তানের শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষমও হন তিনি।
নিশাতকে নিয়ে সফলতার গল্প হয়তো অনেক করা যাবে। রাজনীতি, আইন পেশা, সাংবাদিকতা সর্বোপরি সমাজসেবায়। তবে ভালো লাগার ব্যাপারটি ঘটে গত সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে। সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় অভিভূত নিশাত গত ২০১৪ সালের ৩১ মার্চের নির্বাচনে ‘কলস’ প্রতীক নিয়ে ৭৫ হাজার ৫৫২ ভোট পেয়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ ভোটে তার এই বিজয় রাজনৈতিক অঙ্গণে আবারও আলোচনায় নিয়ে আসে তাকে। এর আগে তৃণমূলের সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনীত হন। যোগ্যতার বিচারে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির ভোটারদের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন নারী আসনের এ প্রার্থী।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পরিষদের দোতলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের কক্ষটি সব সময় মুখরিত থাকে সমাজের অসহায়-দরিদ্র, তৃণমূলের নারী প্রতিনিধিদের পদচারণায়। যা আগে কখনো দেখা যায়নি। সব কিছুতে অসহায়-অবলাদের ভরসাস্থল যেন উপজেলা পরিষদের এই নারী প্রতিনিধি। তবে নিশাতও বসে নেই। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করার কাজকে গুরত্ব দিয়ে তিনি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। দায়িত্ব নেয়ার ৮ মাসের মধ্যে তিনি ধাত্রী ও হস্ত শিল্প বিষয়ে ৬টি প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এতে ২১০ জন নারী স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়াও সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অসহায় নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন নিশাত।
নিশাত মনে করেন, এসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই একজন নারী আত্মনির্ভরশীল হয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। তাদের আর পরনির্ভরশীল হতে হবে না। তাই একেই তিনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তবে প্রতিবন্ধীদের সেবায়ও দীর্ঘ সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এই নারী নেত্রী। সুইড পরিচালিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসমাতুন্নেছা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৫ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর যুক্ত হন আইন পেশায়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের এপিপি (সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর) নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং ওই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন নিশাত। পরবর্তীতে জেলা ছাত্রলীগের মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘ এই সময়ে নানা আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে একাধিক মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে।
নিশাত ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্টের’ প্রতিনিধি হয়ে দরিদ্র নারী সমাজের কল্যাণে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ এর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ২০০৩ সালে ভারত এবং ২০০৫ সালে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, পার্থ, সিডনী ও সিঙ্গাপুর সফর করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারীদের ক্রীড়া উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তার। তিনি জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাংগঠনিক সম্পাদিকা হিসেবে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনরে সময় ক্রীড়া দলের টিম লিডার হিসেবে বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দলের ব্যাপক সফলতা বয়ে আনতে সক্ষম হন।
নিশাত জাগো নিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত তিনি তার উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অসহায় নারীদের হস্ত শিল্প, ধাত্রী, সেলাই ও ব্লকসহ বিভিন্ন শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এর ফলে পাঁচ শতাধিক নারী আজ স্বাবলম্বী। বিশেষ করে যারা স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা বা যাদের বিয়ে হচ্ছে না এবং যারা লেখাপড়া জানে না সেইসব অসহায় নারীদেরই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। নিশাত চান সমাজের প্রতিটি নারী যেন আত্মনির্ভরশীল হয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকেন।
এদিকে নিশাতকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশ কয়েকজন নারী প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন নির্বাচনে বিজয়ী হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন নিশাত।
এসএস/পিআর