বিষখালী নদীর নামকরণের ইতিহাস

দুই পারে সবুজ গাছগাছালি। সেসব গাছের শাখায় শাখায় পাখির কুহুতান। মাঝখানে নদীর জলকেলি, কলকল ধ্বনি। সেই ধ্বনি শুনে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। এসব কারণে এখানে ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনাও নেহায়েত কম নয়। বলছি দক্ষিণবঙ্গের নদী বিষখালীর কথা। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে প্রকৃতির বুক চিরে বয়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন বিষখালী। এ নদী প্রাচীনকাল থেকেই প্রসার ঘটিয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠীর সভ্যতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের। যোগসূত্র স্থাপন করেছে গ্রামের সঙ্গে নগরের। তবে অনিন্দ্যসুন্দর এ নদীর নামকরণে আছে নানা দুঃখের কাহিনি।
অবস্থান
বিষখালী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলার একটি নদী। ঝালকাঠি শহরের কাছে সুগন্ধা নদী থেকে এর উৎপত্তি। এ নদীর জলধারা রাজাপুর, কাঁঠালিয়া অতিক্রম করে বরগুনায় ঢুকেছে। বিষখালী বরগুনার বামনা-বেতাগী ও সদর উপজেলার পাশ ঘেঁষে পাথরঘাটা উপজেলার ১৩ কিলোমিটার ভাটিতে বলেশ্বর-হরিণঘাটা মোহনায় এসে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নদীটির দৈর্ঘ ১০৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৬০ মিটার। এর প্রকৃতি সর্পিলাকার। বিষখালী নদীকে ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৬০’ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বিষখালী নদীটি অত্যন্ত খরস্রোতা। উজানের তুলনায় ভাটির দিকে প্রশস্ততা বেশি। সারাবছরই এ নদীতে পানিপ্রবাহ থাকে। ছোট-বড় নৌযানও চলে। বর্ষাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়। জোয়ার-ভাটাও এ নদীর চিরায়ত অনুষঙ্গ।
নামকরণ
জানা যায়, একসময় বিষখালীর উত্তাল ঢেউয়ে কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া খালের গোঁড়ার অংশে তুফানে প্রায়ই নৌকা ডুবতো। ফলে এখান থেকে মাঝিরা পারাপারের ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখাতেন। তারপরও নদী পারাপারে অনেকে মাঝিদের পীড়াপীড়ি করতেন। তাদের প্রচণ্ড চাপে এক মাঝি নৌকা পাড়ি না দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ নিয়ে এলাকায় প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘বিষখাইলি তো পাড়ি দিলি না’। সেই ‘বিষখাইলি’ থেকেই নামকরণ হয় বিষখালী।
নদীটির নামকরণের বিষয়ে আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে কাঁঠালিয়া-বামনা জনপদে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭৯৯ সালের গোঁড়ার দিকে বামনায় তালুক ছিল। তাদেরই একজন ১৮০০ সালে বরিশালের দুপাশা গ্রামের শফিজ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি চাইনিজদের সহায়তায় লবণের ব্যবসা শুরু করেন। বামনা উপজেলার উত্তর প্রান্তে একটি ছোট লবণ কারখানা স্থাপন করেন। পরে ঘটনাক্রমে তিনি মুখে বিষ নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিহত হন। সেই বিষ খাওয়া লোকটিকে দেখতে শত শত মানুষ উপস্থিত হন। সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে এ কাহিনি। সেই থেকেই ‘বিষখাইলি’ থেকে নাম হয় বিষখালী।
আরও পড়ুন
বিষখালী নদী সমুদ্রের সঙ্গে মিলেছে বলে এর পানি বেশ লবণাক্ত ছিল। এতটাই লবণাক্ত ছিল যে, মানুষ পানি মুখে নিতে পারতেন না। কথিত আছে, দরবেশ নেয়ামত শাহের বোন চিনিবিবি হঠাৎ একদিন নদীতে নেমে ওই পানি মুখে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি পানি ঢোক গিলে ফেলেন এবং বলেন, ‘পানির বিষ খাইয়া ফেললাম’। সেই থেকে নদীর পানি থেকে লবণ কমে যায়। তখন থেকে নদীর নাম বিষ খাই থেকে বিষ খালি, অর্থাৎ বিষশূন্য।
বিষখালী একটি ছোট্ট নাম অথচ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কত গভীরতা; যা প্রভাব বিস্তার করে জনপদের জীবনে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার এক অমর গাথা বুকে নিয়ে বিষখালীর নিরন্তর ছুটে চলা। বিষখালী নামকরণের ক্ষেত্রে মতভেদ থাকলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতির এক মিশ্র অনুভূতি।
বিষখালীর ঐতিহ্য
বিষখালীর বিভিন্ন স্থানে আছে নানা চর-দ্বীপ। সেই সৌন্দর্যের টানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে যান। বিষখালীর এ পথে একসময় বরগুনা, ঝালকাঠি ও বরিশাল রুটে স্টিমার ও লঞ্চ চলাচল করতো। বর্তমানে বরগুনা-ঢাকা রুটে এ নদী থেকেই লঞ্চ যাতায়াত করে। এ নদীর ইলিশের বেশ কদর আছে দেশজুড়ে। বিষখালীর ইলিশ স্বাদেও অতুলনীয়। বাজারে এ ইলিশের চাহিদা বেশি। দামও অন্য নদী ও সাগরের ইলিশের তুলনায় একটু বেশি।
নদীর দুঃখ
তবে এ নদীতেও দুঃখ বয়। নদীটির নানা স্থান ভাঙনপ্রবণ। ঝড়-বন্যা-নিম্নচাপে নদীটি রাগী মেয়ের মতোই ফুঁসে ওঠে। তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তীরবর্তী জনপদ। বিষখালী নদীর ভাঙন ঝালকাঠি-বরগুনা জেলার নদী তীরবর্তী এলাকার জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে বহু ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি, গাছপালা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের শিকার জনপদগুলোর বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
এসইউ/এমএস