কৃষিতে প্রভাব
ঐতিহ্য হারাচ্ছে শতবর্ষী হাট-বাজার
বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ হাট-বাজার। তৎকালীন গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব ছিল হাট-বাজারের নাম। তেমনই চট্টগ্রামের প্রবেশপথ ‘মিরসরাই উপজেলা’ নামকরণেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ঐতিহ্যকে। প্রাচীণকাল থেকে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে আসছে হাট-বাজার। তবে কালের বিবর্তনে বিলীন হচ্ছে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য। ফলে প্রভাব পড়ছে কৃষিতেও। এখন আর কৃষিপণ্য বাজারে নিয়ে দাম যাচাই করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। পাইকাররাই জমি থেকে কিনে নিয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরসরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী হাট-বাজারগুলোর অন্যতম করেরহাট, বারইয়ারহাট, শান্তিরহাট, আবুরহাট, বামসুন্দর দারোগারহাট, বড়দারোগারহাট, হাদিরফকিরহাট, মিঠাছড়া, মিরসরাই, বড়তাকিয়া, আবুতোরাব, আবুরহাট, সারেখালী ভোরেরবাজার উল্লেখযোগ্য। এখন এসব বাজারে আগের সেই জৌলুস নেই। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আর এসব বাজারে ছুটে আসে না। প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট অনেক বাজার। বাড়ির পাশে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। মানুষ এখন আর দূরে বাজার করতে যায় না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দুইদিন করে বসতো হাট-বাজারগুলো। মানুষ এ দুইদিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি-পণ্য বেচাকেনা করতে অনেক দূর থেকে ছুটে আসতো। বাজার হয়ে উঠতো রীতিমত মিলনমেলা। প্রবাসী ও দেশের দূর-দূরান্তে জীবিকার তাগিদে অবস্থানরত মানুষ বাজারে এলে দেখা হতো। একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে চলে যেত আধাবেলা। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। তাই কমেছে সাপ্তাহিক হাট-বাজারের কদর। বিলিন হয়ে গেছে গ্রামবাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী গ্রামীণ হাট-বজার। তবে বছর ঘুরে কোরবানির পশুর হাটে কিছুটা ঐতিহ্য লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুন: হলুদের সমারোহে পাল্টে গেছে সাতক্ষীরার দৃশ্যপট
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন আবুতোরাব ও শান্তিরহাট বাজার। এ দুটি বাজারের শতবর্ষী ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। শান্তিরহাট বাজারের নামকরণে রয়েছে করুণ ইতিহাস। শান্তিরহাট প্রতিষ্ঠার আগে তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর প্রতিষ্ঠিত ‘মহাজন হাট’ বসতো। হাটে পণ্য বিক্রি করতে হলে জমিদারকে দিতে হতো চড়া কর। জমিদার বাড়ির মালি থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সাতজনের জন্য নিয়মিত তোলা হতো কর। এজন্য বাজারে আগত বিক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এক হতদরিদ্র বিধবা নারী ৮ মাইল দূর থেকে ৮ আঁটি ঢেঁকি শাক হাটে বিক্রি করতে আনেন। ফলে কর সুলভ তার থেকে ৭ আঁটি শাক কেড়ে নেওয়া হয়। অবশিষ্ট ১ আঁটি শাক বিক্রি করে পরিবারের অন্ন জোগাড় করতে না পেরে ওই নারী অঝরে কাঁদতে থাকেন। হাটে আসা লোকজন এ দৃশ্য দেখে তাকে নিয়ে জমিদার বাড়িতে গিয়ে বিচার দিলে জমিদার তার দাসদের পক্ষে অবস্থান নেন। এরপর জনমনে ক্ষোভের জেরে উত্তেজিত জনতা হাট ভেঙে দেন। এরপর স্থানীয় বিত্তশালীদের সহযোগিতায় একটি নতুন হাট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সব অশান্তি দূর করে সবার সম্মতিক্রমে নতুন প্রতিষ্ঠিত বাজারের নাম দেওয়া হয় শান্তিরহাট। সেই থেকে শতবর্ষের ঐতিহ্য বহন করে শান্তিরহাট বাজার। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণেও এ হাটের ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
আবুতোরাব বাজারের ষাটোর্ধ্ব আবদুল করিম বলেন, ‘সপ্তাহে দুদিন সোমবার-শুক্রবার বাজার বসে। আগের মতো বাজার বসার কোনো হিসাব নাই। প্রতিদিন বাজার বসে, কী সকাল কী সন্ধ্যা। একটা সময় সপ্তাহে বাজারবার এলে হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। বড় বাজার হওয়ায় বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ও পাইকাররা এসে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পণ্য কিনে নিয়ে যেত। এখন কেবলই স্মৃতি।’

শান্তিরহাট এলাকার বাসিন্দা ওহিদুর রহমান (৭৫) বলেন, ‘মিরসরাইয়ের প্রাচীন হাটগুলোর একটি শান্তিরহাট। এটি শতবর্ষী ঐতিহ্য বহন করে। একসময়ে নৌপথে বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য আসতো। এখানে বাজারের দিন হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। প্রবাসীরা দেশে এলে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করতে চলে যেত আধাবেলা। সপ্তাহে শনি-মঙ্গলবার হাটের ঐতিহ্য থাকলেও এখন হাটবারের কদর আগের মতো নেই।’
আরও পড়ুন: বিষমুক্ত লাউ চাষে সফল শার্শার শফিকুল
ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার সুকুমার চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে শাক-সবজি, ধানসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বড়দারোগারহাট বাজারে যেতাম। তখন খুব বেশি গাড়ি চলাচল করতো না। মাথায় করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। বিক্রি করা টাকা দিয়ে আবার টুকরি করে পুরো এক সপ্তাহের বাজার নিয়ে আসতাম। তখন আলাদা আনন্দ ছিল। এখন এগুলো শুধুই স্মৃতি।’
উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সলিম উল্যাহ বলেন, ‘দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতির একটি অংশ বহন করে গ্রামীণ হাট-বাজার। কালের বিবর্তনে এ ঐতিহ্য এখন আর দেখা যায় না। বর্তমান প্রজন্ম হাট-বাজারের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানেই না। মিরসরাইয়ের অনেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার নামকরণেও বাজারগুলোর ঐতিহ্য প্রাধান্য পেয়েছে। ২০ বছর আগেও করেরহাট বাজারে রবি-বুধবার এলে প্রচুর মানুষের আগমন ঘটতো। এখন বাজারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বারের প্রয়োজন হয় না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এসব ঐতিহ্য।’
করেরহাট বাজার কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘ফেনী নদী ঘেঁষে করেরহাট বাজারের অবস্থান। আশপাশের লোকজন নৌকাযোগে বাজারে আসা-যাওয়া করতেন। পাশের ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফটিকছড়ি, রামগড় উপজেলার মানুষ এখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে আগের সেই জৌলুস।’
এসইউ/জেআইএম