একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের দেশের ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত ঘটে থাকে। ভোট দিতে গিয়ে শুনতে হয় ‘আপনার ভোট হয়ে গেছে’; তখন মন খারাপ করে ফিরে আসেন ভোটার, করেন ক্ষোভ প্রকাশ। এ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার ঘটনাও ঘটে, অনেক সময় যা গিয়ে দাঁড়ায় হতাহতের পর্যায়ে।
তবে এ অবস্থার বিকল্প থাকলেও জানেন না অনেক ভোটার। ভোট দেওয়া হয়ে গেলেও সুযোগ থাকে আবার ভোট দেওয়ার। নির্বাচন কমিশনের ভাষায় যাকে বলে ‘টেন্ডার্ড ভোট’ বা ‘সান্ত্বনা ভোট’। যদিও এই ভোট প্রাথমিকভাবে গণনা করা হয় না। তবে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হলে এ ভোট গণনা হতে পারে। এটি জটিল প্রক্রিয়া, নিজের ভোট গণনা করতে সাধারণত কেউ আদালতের দ্বারস্থ হন না। সে কারণেই এটা ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের ‘প্রতারণা’ বলে দাবি নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের।
ভোটারদের ‘সান্ত্বনা’ দিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও থাকছে এ ব্যবস্থা। নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আরপিও’তে টেন্ডার্ড ভোটিং বা ‘সান্ত্বনা ভোট’র সিস্টেম রাখা হয়েছে। এটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। নতুন সংশোধনীতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুনএকজন প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোট, আরপিও মন্ত্রণালয়ে পাঠালো ইসিপিআর পদ্ধতি আরপিও-সংবিধানে নেই: সিইসিবিশ্বের যেখানেই থাকুন, ভোট দিতে পারবেন প্রবাসীরা: সিইসি
টেন্ডার্ড ভোট প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোটাররা প্রতারণার শিকার হন। কিন্তু কমিশন যদি তৎপর না হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হয়, তাহলে কিছু হবে না।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন একেবারে শুদ্ধ করা, নির্বাচন পরিপূর্ণ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য এগুলো দরকার। নির্বাচন যেন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়, সেটাই অর্জন করার চেষ্টা করছি। থাকুক না এটা (টেন্ডার্ড ভোট), এটা আগেও ছিল, তাই পরিবর্তন করতে চাই না। এটা অত গুরুত্বপূর্ণও না।’
নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, ‘ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যদি দেখেন আপনার ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে হতাশ হবেন না। কারণ নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, আপনি যদি ভোটার স্লিপ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে কিংবা নিজের আঙুলের ছাপের মাধ্যমে আপনার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আপনার ভোট গ্রহণ করতে বাধ্য। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার তার সই করা কাগজে আপনার সিল নিয়ে সেটা নিজের কাছে রাখবেন। এই ভোটকে বলা হয় টেন্ডার্ড ভোট। এটা ব্যালট বাক্সে ফেলা হওয় না, এমনকি গণনাও করা হয় না। তবে প্রিসাইডিং অফিসার টেন্ডার্ড ভোট সংরক্ষণে রাখেন। এটার মাধ্যমে ভোটারকে শুধু সান্ত্বনা দেওয়া হয়।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেন্ডার্ড ভোটের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়, যা করা হচ্ছে নির্বাচন সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে। ইসি অনিয়মের বৈধতা আইন করে দিচ্ছে।
আরও পড়ুনসংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ ২০ অক্টোবরদৃশ্যমান ও অদৃশ্য অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে: সিইসিকেউ কেউ বলছে এবার ৭০ শতাংশ ভোট কাস্টিং হবে: ইসি আনোয়ারুল
এ বিষয়ে জানতে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীমকে কল করলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি প্রকৃত ভোটারের ভোট কোনোভাবে আগেই দিয়ে থাকেন সেটা জাল ভোট আকারে হোক বা ভুলবশত হোক; যিনি প্রকৃত ভোটার তিনি যদি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হন তখন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ভোটটা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এটা কখনই গণনা করা হয় না। এটা একদিক থেকে চিন্তা করলে ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা। ভোটার জানতে পারছেন তার ভোট নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তিনি জানতে পারছেন না তার ভোট গণনা করা হচ্ছে কি না। যারা অসচেতন তারা বুঝতে পারবেন না গণনা করা হচ্ছে কী হচ্ছে না। কাজেই ওনাকে একভাবে প্রতারিত করা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় এটা না থাকাই ভালো।’
তবে ইভিএমে ভোট হলে টেন্ডার্ড ভোটের কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু ইভিএম এবার জাতীয় নির্বাচনে থাকছে না, সুতরাং টেন্ডার্ড ভোটের অপশন থাকছে। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না বলে রাখা হয়েছে- এমন মত দিয়েছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
টেন্ডার ভোট মূল ভোট গণনার সঙ্গে গণনা করা হয় না। নির্বাচনের শেষে ফল ঘোষণার সময় টেন্ডার ভোট মূল গণনার সঙ্গে যুক্ত করা হয় না। যদি দেখা যায় দুই প্রার্থীর মধ্যে জয়ের ব্যবধান প্রদত্ত টেন্ডার ভোটের থেকে কম হয়, তখন পরাজিত প্রার্থী আদালতের দ্বারস্থ হয়ে আবেদন করতে পারেন এবং টেন্ডার ভোট গণনার দাবি জানাতে পারেন। তবে শুধু হাইকোর্টের নির্দেশেই টেন্ডার ভোট তখন মূল ভোট গণনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। আদালত না চাইলে টেন্ডার্ড ভোট গ্রহণার কোনো সুযোগ নেই।
এক সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডার্ড ভোটের প্রক্রিয়া কেন রাখা হলো জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘টেন্ডার্ড ভোটের অপশন তো আগে থেকেই আছে। সংস্কার কমিশনও রিকমেন্ড করেনি, তাই রাখা হয়েছে।’
এমওএস/ইএ/জেআইএম