সুকুমার রায়ের মজার গল্প: ছাতার মালিক
তারা দেড় বিঘৎ মানুষ। তাদের আড্ডা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার ছায়ার তলায়। ছেলেবেলায় যখন তাদের দাঁত ওঠেনি, তখন থেকে তারা দেখে আসছে, সেই আদ্যিকালের ব্যাঙের ছাতা। সে যে কোথাকার কোন ব্যাঙের ছাতা, সে খবর কেউ জানে না, কিন্তু সবাই বলে, ‘ব্যাঙের ছাতা।’
যত সব দুষ্টু ছেলে, রাত্রে যারা ঘুমোতে চায় না, মায়ের মুখে ব্যাঙের ছাতার গান শুনে শুনে তাদেরও চোখ বুজে আসে।
গালফোলা কোলা ব্যাং, পালতোলা রাঙা ছাতা
মেঠো ব্যাং, গেছো ব্যাং, ছেঁড়া ছাতা, ভাঙা ছাতা।
সবুজ রং জবড়জং জরির ছাতা সোনা ব্যাং
টোক্কা-আঁটা ফোকলা ছাতা কোঁকড়া মাথা কোনা ব্যাং।।
কত ব্যাঙের কত ছাতা!
কিন্তু আজ অবধি ব্যাংকে তারা চোখে দেখেনি। সেখানে মাঠের মধ্যে ঘাসের মধ্যে, সবুজ পাগলা ফড়িং থেকে তুড়ুক করে মাথা ডিঙিয়ে লাফিয়ে যায়; সেখানে রং-বেরঙের প্রজাপতি, তারা ব্যস্ত হয়ে ওড়ে আর বসতে চায়, বসে আর উড়ে পালায়; সেখানে গাছে গাছে কাঠবেড়ালি সারাটা দিন গাছ মাপে আর জরিপ করে, গাছ বেয়ে ওঠে আর গাছ বেয়ে নামে, আর রোদে বসে গোঁফ তাওয়ায় আর হিসেব কষে। কিন্তু তারাও কেউ ব্যাঙের খবর বলতে পারে না।
গ্রামের যত বুড়োবুড়ি, আর ঠাকুরমা, তারা বলেন, আজও সে ব্যাং মরেনি, তার ছাতার কথা ভোলেনি। যখন ভরা বর্ষায় বাদল নামে, বন-বাদাড়ে লোক থাকে না, ব্যাং তখন আপন ছাতার তলায় বসে মেঘের সঙ্গে তর্ক করে। যখন নিশুত রাতে সবাই ঘুমোয়, কেউ দেখে না, তখন ব্যাং এসে তার ছাতার ছাওয়ায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বুক ফুলিয়ে তান জুড়ে দেয়,‘দ্যাখ দ্যাখ দ্যাখ এখন দ্যাখ।’ কিন্তু সেদিন সব দুষ্টু ছেলে জটলা করে বাদলায় ভিজে দেখতে গেল, কই তারা ত কেউ ব্যাঙ দেখেনি। আর যে বার তারা নিঝুম রাতে ভরসা করে বনের ধারে কান পেতেছে, সেবারে তো কই গান শোনেনি!
কিন্তু ছাতা যখন আছে, ব্যাং তখন না এসে যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ব্যাং ফিরে আসবেই আসবে,— আর বলবে, ‘আমার ছাতা কই?’ তখন তারা বলবে, ‘এই যে তোমার আদ্যিকালের নতুন ছাতা নিয়ে যাও। আমরা ভাঙিনি, ছিঁড়িনি, নষ্ট করিনি, নোংরা করিনি, খালি ওর ছায়ায় বসে গল্প করেছি।’ কিন্তু ব্যাঙও আসে না, ছাতাও সরে না, ছায়াও নড়ে না, গল্পও ফুরোয় না।
এমনি করেই দিন কেটে যায়, এমনি করেই বছর ফুরোয়। হঠাৎ একদিন সকাল বেলায় গ্রাম জুড়ে এই রব উঠল, ‘ব্যাঙ এসেছে, ব্যাঙ এসেছে। ছাতা নিতে ব্যাঙ এসেছে!’
কোথায় ব্যাঙ? কে দেখেছে? বনের ধারে ছাতার তলায়; লালু দেখেছে, ফালু দেখেছে, চাঁদা ভোঁদা সবাই দেখেছে। কী করছে ব্যাঙ? কী রকম দেখতে? লালু বললে, ‘পাটকিলে লাল ব্যাঙ যেন হলুদগোলা চুন। এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।’ ফালুল বললে, ‘ছাইয়ের মতন ফ্যাক্সা রং, এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।’ চাঁদা বললে, ‘চকচকে সবুজ, যেন নতুন কচি ঘাস— এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।’ ভোঁদা বললে, ‘ভুসো-ভুসো রং, যেন পুরোনো তেঁতুল- এক চোখ বোজা, এক চোখ খোলা।’
গ্রামের যত বুড়ো, যত মহা-মহা পণ্ডিত সবাই বললে, ‘কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। তোরা কী দেখেছিস আবার বল।’ লালু কালু চাঁদা ভোঁদা আবাই বললে, ‘ছাতার তলায় জ্যান্ত ব্যাঙ, তার চার হাত লম্বা ল্যাজ।’ শুনে সবাই মাথা নেড়ে বললে, ‘উঁহু উঁহু! তাহলে কক্ষনো সেটা ব্যাং নয়, সেটা বোধহয় ব্যাঙের বাচ্চা ব্যাঙ্গাচি। তা নইলে ল্যাজ থাকবে কেন?’
ব্যাং না হোক, ব্যাঙের ছেলে তো বটে ছেলে না হোক নাতি, কিংবা ভাইপো কিম্বা ব্যাঙের কেউ তো বটে। সবাই বললে, ‘চল চল দেখবি চল, দেখবি চল।’ সবাই মিলে দৌড়ে চলল।
মাঠের পারে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার আগায় বসে কে একজন রোদ পোয়াচ্ছে। রঙটা যেন শ্যাওলা-ধরা গাছের বাকল, ল্যাজখানা তার ঘাসের উপর ঝুলে পড়েছে, এক চোখ বুজে এক চোখ খুলে একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে। সবাই তখন চেঁচিয়ে বললে, ‘তুমি কে হে? কস্ত্বম? তুম, কোন হায়? হু আর ইউ?’ শুনে সে ডাইনেও তাকালে না, বাঁয়েও তাকালে না, খালি একবার রং বদলিয়ে খোলা চোখটা বুজলে আর বোজা চোখটা খুললে, আর চিড়িক করে এক হাত লম্বা জিভ বার করেই তক্ষুনি আবার গুটিয়ে নিলে।
গ্রামের যে হোমরা বুড়ো, সে বললে, ‘মোড়ল ভাই, ওটা যে জবাব দেয় না? কালা না কি?’ মোড়ল বললে, ‘হবেও বা।’ সর্দার খুড়ো সাহস করে বললে, ‘চল না ভাই, এগিয়ে যাই, কানের কাছে চেঁচিয়ে বলি।’ মোড়ল বললে, ‘ঠিক বলেছ।’ হোমরা বললে, ‘তোমরা এগোও। আমই এই আঁকশি নিয়ে ঐ ঝোপের মধ্যে উঁচিয়ে বসি। যদি কিছু করতে আসে, ঘ্যাচাং করে কুপিয়ে দেব।’
তখন সর্দার সেই ছাতার উপর উঠে ল্যাজওয়ালাটার কানের কাছে হঠাৎ ‘কোন হা-য়’ বলে এমনি জোরে হাঁকড়ে উঠল যে, সেটা আরেকটু হলেই ছাতার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হ'য়ে থেকে, দু'চোখ তাকিয়ে বললে, ‘উঃ? অত চেঁচান কেন মশাই? আমি কি কালা?’ তখন সর্দার নরম হয়ে বললে, ‘তবে যে জবাব দিচ্ছিলে না?’ ল্যাজওয়ালা বললে, ‘দেখছেন না, মাছি খাচ্ছিলাম? কি বলতে চাচ্ছেন বলুন না?’
সর্দার তখন থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললে, ‘বলছিলাম কি, তুমি কি ব্যাঙের ছেলে, না ব্যাঙের নাতি, না ব্যাঙের—’ ল্যাজওয়ালা তখন বেজায় চটে গিয়ে বললে, ‘আপনি কি আরসুলার পিশে? আপনি কি চামচিকের খোকা?’ সর্দার বললে, ‘আহা, রাগ করছ কেন?’ সে বললে, ‘আপনি আমায় ব্যাঙ ব্যাঙ করছেন কেন?’ সর্দার বললে, ‘তুমি কি ব্যাঙের কেউ হও না?’ জন্তুটা তখন, ‘না না না না কেউ না কেউ না বলে, দুই চোখ বুজে ভয়ানক রকম দুলতে লাগলো।’
তাই না দেখে সর্দার বুড়ো চিৎকার করে বললে, ‘তবে যে তুমি ছাতা নিতে এয়েছ?’ সঙ্গে সঙ্গে সবাই চেঁচাতে লাগল, ‘নেমে এসো, নেমে এসো, শিগগির নেমে এসো।’ মোড়ল খুড়ো ছুটে গিয়ে প্রাণপণে তার ল্যাজটা ধরে টানতে লাগল। আর হোমরা বুড়ো খোপের মধ্যে থেকে আঁকশিটা উঁচিয়ে তুলল। ল্যাজওয়ালা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘কি আপদ! মশাই, ল্যাজ ধরে টানেন কেন? ছিঁড়ে যাবে যে?’ সর্দার বললে, ‘তুমি কেন ব্যাঙের ছাতায় চড়েছ? আর পা দিয়ে ছাতা মাড়াচ্ছ?’ জন্তুটা তখন আকাশের দিকে গোল গোল চোখ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বললে, ‘কি বললেন? কিসের কী?’ সর্দার বললে, ‘বললাম যে ব্যাঙের ছাতা।’
যেমনি বলা, অমনি সে খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক্ করে হাসতে হাসতে হাসতে হাসতে, একেবারে মাটির উপর গড়িয়ে পড়ল। তার গায়ে লাল নীল হলদে সবুজ রামধনুর মতো অদ্ভুত রং খুলতে লাগল। সবাই ব্যাস্ত হয়ে দৌড়ে এল। ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’ কেউ বললে, ‘জল দাও,’ কেউ বললে, ‘বাতাস কর।’ অনেকক্ষণ পর জন্তুটা ঠাণ্ডা হয়ে, উঠে বললে, ‘ব্যাঙের ছাতা কি হে? ওটা বুঝি ব্যাঙের ছাতা হলো? যেমন বুদ্ধি তোমাদের! ওটা ছাতাও নয়, ব্যাঙেরও কিছু নয়। যারা বোকা, তারা বলে ব্যাঙের ছাতা।’ শুনে কেউ কোনো কথা বলতে পারলে না, সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শেষকালে ছোকরা মতো একজন জিজ্ঞাসা করলে, "আপনি কে মশাই?’ ল্যাজওয়ালা বললে, ‘আমি বহুরূপী- আমি গিরগিটির খুড়তুত ভাই, গোসাপের জ্ঞাতি। এটা এখন আমার হলো আমি বাড়ি নিয়ে যাব।’
এই বলে সে ব্যাঙের ছাতাটাকে বগলদাবা করে নিয়ে, গম্ভীরভাবে চলে গেল। আর সবাই মিলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
লেখা: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/এএসএম