ইডেন ‘চালাচ্ছে’ ছাত্রলীগ

নির্যাতনের তথ্য গণমাধ্যমে জানানোয় শোকজ!

আল সাদী ভূঁইয়া
আল সাদী ভূঁইয়া আল সাদী ভূঁইয়া , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৫১ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২২
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা

 

#নির্যাতনের পর ভুক্তভোগীদেরই হল থেকে বের করে দেওয়া হয়
#একাধিক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তি না হওয়ায় আরও বেপরোয়া
#তামান্না জেসমিন রিভাকে নিয়ে কথা বলছে না প্রশাসন
#তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলছেন কেন্দ্রীয় সভাপতি

ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে দফায় দফায় ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এই নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাদের গভীর রাতে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কলেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। নির্যাতনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এই নির্যাতনের তথ্য গণমাধ্যমে যাওয়ায় কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশও দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি রিভার নেতৃত্বে এসব নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা শিক্ষার্থীদের হতভম্ব করে দিয়েছে। কেউ সরাসরি মুখ খুলতে না চাইলেও বলছেন, ইডেন কলেজ যেন ছাত্রলীগই ‘চালাচ্ছে’। যদিও কলেজ অধ্যক্ষ দাবি করছেন, নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়।

সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ। বিশেষ করে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা আছেন আলোচনার কেন্দ্রে। গত ১৯ আগস্ট রিভা ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি দেওয়ার একটি অডিও ফাঁস হলে তা নিয়ে জাগো নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়। যদিও পরে এ নিয়ে ক্ষমা চান তিনি। অভিযোগ ওঠে, সেই অডিও ফাঁস হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রিভা গত ২৩ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে রাজিয়া হলের ২০২ নাম্বার কক্ষ থেকে বঙ্গমাতা হলের ১১০৭ নাম্বার রুমে নিয়ে যান দুই ছাত্রীকে। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সেখানে দুজনকে আটকে রাখা হয়। সেখানে তিনি দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেন। খবর পেয়ে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ও রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ গিয়ে দুজনকে করে হল অফিসে নিয়ে আসেন।

সূত্র জানায়, ছাত্রী দুজনকে উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে গভীর রাতেই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় কলেজ প্রশাসন। অথচ অভিযুক্ত রিভার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। উল্টো ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ের ভিডিও ধারণ করে গণমাধ্যমে দেওয়ার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেন রাজিয়া হল প্রাধ্যক্ষ। নোটিশে বলা হয়, ‘গত মঙ্গলবার আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে তুমি আকস্মিক প্রবেশ এবং অফিসিয়াল কথাবার্তা রেকর্ড করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করেছো, যেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তোমার বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না এ ব্যাপারে নোটিশ প্রাপ্তির পর আগামী বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) দুপুর ১২টার মধ্যে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিতভাবে উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’

শোকজ নোটিশ পাওয়া ছাত্রলীগের নেত্রীদের কাছে জানতে চাইলে তারা নাম প্রকাশ করতে অনীহা জানান। তারা জাগো নিউজকে বলেন, কে বা কারা এ ভিডিও করেছে তা আমরা জানিই না। হঠাৎ করে বিকেলে আমাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে যায়। যারা কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছে তাদের সবাইকে রিভা সন্দেহ করছেন। আর রিভার সেই সন্দেহকেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে হল প্রশাসন।

রিভায় তটস্থ ইডেন কলেজ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, সভাপতি হওয়ার পর থেকে রিভা শিক্ষার্থীদের জোর করে মিছিল-মিটিংয়ে নিয়ে যান। অসুস্থ কিংবা মাসিকের মতো সংবেদনশীল সমস্যার কথা বললেও কোনো ধরনের ছাড় দেন না তিনি। উল্টো ‘আইসিইউতে থাকলেও প্রোগ্রামে যেতে হবে’ বলে হুমকি দেন তিনি। এসব সমস্যা নিয়ে কর্মসূচিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের একটি কর্মসূচিতে জোরপূর্বক যাওয়ার পর এক শিক্ষার্থী হিট স্ট্রোক করে তিন ঘণ্টা বেহুঁশ ছিলেন। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, এভাবে মানসিক নির্যাতনেরই ধারাবাহিকতা ১৯ ও ২৩ আগস্টের ঘটনা। এ দুটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার কল্যাণেই রিভার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে, যদিও এসব কর্মকাণ্ড চলছিল বহু আগে থেকে।

এদিকে শিক্ষার্থী নির্যাতনে প্রতিবাদে গত ২৪ আগস্ট সকাল ৯টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করার কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠান ইডেন কলেজের ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা’। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই কর্মসূচির বিষয়টি রিভা জেনে গেলে সব হলে তার নেতাকর্মীদের ফটকে অবস্থান নেওয়ার কথা বলেন। এতে ভয়ে শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। সকালে না পারলেও সন্ধ্যার দিকে আবার মিছিল করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা, কিন্তু রিভার নির্দেশে তার অনুসারীরা একই কাজ করেন।

রিভার দাপটের নেপথ্যে

দুই দফায় ছাত্রী নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও নামতে না দেওয়ার পেছনে তামান্না জেসমিন রিভার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগেরই একটি অংশ। কেউ কেউ বলছেন, অতীতে অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রিভা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ১৯ ও ২৩ আগস্টের ঘটনা দুটির পর রিভার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেয়নি হল প্রশাসন বা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জাগো নিউজের কাছে অভিযোগ করেন, রিভা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী এবং ইডেন কলেজের সার্বিক দায়িত্বে থাকা সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এই পরিচিতিই তাকে ইডেন কলেজে এমন দাপুটে চরিত্র বানিয়েছে।

নির্যাতনের অভিযোগ নাকচ কলেজ কর্তৃপক্ষের

শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে রাজিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ নার্গিস রুমাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি প্রত্যেকবার ফোন কেটে দেন। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে ইডেন মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ওরকমভাবে কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের হল কর্তৃপক্ষ দেখছে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। আমাদের কলেজের পরিবেশ অনেক ভালো আছে। অডিও ক্লিপ যেটা আসছিল সেটার জন্য ও (রিভা) সরি বলেছে। এটা তো আপনারা দেখেছেন।

দ্বিতীয় দফায় ২৩ আগস্ট নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হলে কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এ জিনিসটা নেই।

তবে রিভার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলে ফোন কেটে দেন।

শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য জাগো নিউজকে বলেন, নির্যাতনের ঘটনা সত্য নয়। হল কর্তৃপক্ষ অবশ্যই হলের মেয়েদের আচরণ নিয়ে বকাঝকা করতে পারে। সেটা ভিডিও করে যদি কেউ মিডিয়াতে দেয় তাহলে অবশ্যই তাকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিতে পারে।

তবে কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রিভার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান।

দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যবস্থা: আল নাহিয়ান খান জয়

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও মেলেনি তার সাড়া।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সোহান খান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। কেউ যদি তাদের পাশে না থেকে তাদের নির্যাতন করে তাহলে এ দায় ব্যক্তির। এক্ষেত্রে ব্যক্তির দায় সংগঠন নেবে না। আমি আশা করবো, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করায় এই নেত্রীর বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যবস্থা নেবেন।

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ ও শাখা সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাত্রলীগ প্রশ্র‍য় দেয় না। ইডেন কলেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বলছি এ ঘটনার খোঁজ নিয়ে তদন্ত করতে। এতে দোষী সাব্যস্ত হলে তার (তামান্না জেসমিন রিভা) বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আল-সাদী ভূঁইয়া/এইচএ/ইএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।