চাকরি-বিদেশে পড়াশোনায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা

মো. নাহিদ হাসান
মো. নাহিদ হাসান মো. নাহিদ হাসান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ০১ অক্টোবর ২০২২

২০১৭ সালের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত হয় রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাবির অভিভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে সাড়ে পাঁচ বছর। শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে এখনো রয়েছে সংকট-সংশয়। অধিভুক্তির পর চাকরির বাজারে যখন ঢাবির সার্টিফিকেট দেখানো হয় সেক্ষেত্রে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও চাকরি ক্ষেত্রে তারা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পায় বলে দাবি সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কারীর।

গত সাড়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে এ কলেজগুলো শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছে, একই সঙ্গে ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা পদ্ধতি, খাতা মূল্যায়নসহ সর্বোপরি শিক্ষা সংকট আদৌ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কি না- এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও অধিভুক্ত সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান

জাগো নিউজ: অধিভুক্তির পর সাত কলেজে শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন কী?

মাকসুদ কামাল: কোনো ধরনের পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। এরই মধ্যে সিংহভাগ পরীক্ষা হয়ে গেছে বা কিছু পরীক্ষা এখনো বাকি। অর্ধেক বা তারও বেশি পরীক্ষা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আর বাকি পরীক্ষাগুলো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। অধিভুক্তির পর কোনো কোনো শিক্ষার্থী ঢাবির আদলে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছিল, যদিও ঢাবিতে এখন প্রিলি নেই। অনার্সের অনেক শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চলে এসেছে।

যে কালচার বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাত কলেজে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছিল, অধিভুক্তির পর সেই কালচার বা প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ফলে এসময়ে শিক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, অনেকে পরীক্ষায় পাস করেনি। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন খাতা মূল্যায়ন করেন তখন ঢাবির স্ট্যান্ডার্ডে মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন। এরপরও অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের এসেছে। সিলেবাসে পরিবর্তন এসেছে, খাতা মূল্যায়নে পরিবর্তন এসেছে। ডেমোনেস্ট্রেটরের (পরীক্ষক) মধ্যেও আমরা স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছি।

ঢাবিতে অধিভুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এজন্য অনেকে ফলাফল খারাপ করেছে, কোনো কোনো বিষয়ে সিংহভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। প্রাথমিকভাবে একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সংকট সমাধানে নানা পন্থা অনুসরণ করছি। সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছি। সমস্যা সমাধানে অধ্যক্ষদের সঙ্গে প্রতি মাসে একটি করে মিটিং করার চেষ্টা করছি। নতুন সিলেবাস প্রণয়ন, যথাসময়ে পরীক্ষা নেওয়া, খাতা মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমি যতদূর জানি, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন সন্তুষ্ট।

জাগো নিউজ: সাত কলেজে শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে। এ সংকটের মধ্যে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা রাখছে?

মাকসুদ কামাল: শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি সংকট আছে। এগুলো আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। নিকট ভবিষ্যতে সাত কলেজের মানোন্নয়নে যা যা করা দরকার আমরা করবো। সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বা দুর্বলতা কী, তা জানাতে বলা হয়েছে। এই কলেজগুলোতে বিজ্ঞানের যে ল্যাব থাকার কথা সেগুলো তেমনভাবে নেই। আমাদের (ঢাবির) বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন উদ্যোগ নিয়ে এসব কলেজের ল্যাবগুলোতে কিছু যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছিলেন। বর্তমানে সাত কলেজের সমন্বয়ক (ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য) আমাকে জানিয়েছেন, কলেজগুলোতে বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদানে মোটামুটি ভালো একটি পরিবর্তন এসেছে।

জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয়েছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাত কলেজে নতুন নতুন বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হবে। এ বিষয়টির অগ্রগতি কোন পর্যায়ে?

মাকসুদ কামাল: আমরা এখন ডিজিটালাইজেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলাইজেশনের যুগে বাস করছি। পৃথিবী দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। এ অবস্থায় যুগোপযোগী কিছু সাবজেক্ট সাত কলেজে চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। তিনি যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজার অর্থনীতিকে পর্যবেক্ষণ করে সাত কলেজে নতুন সাবজেক্ট যেমন- কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনোলজির মতো বিষয়গুলো আনা যায় কি না সেটি দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, এমন বিষয়ে পড়াশোনা শেষে অনেক শিক্ষার্থী বেকারত্বে ভুগছে। বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমিয়ে আনার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী একটি লক্ষ্য স্থির করে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যটি হলো- শিক্ষার মান বাড়ানো এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সামগ্রিকভাবে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

seven-college-Inner

জাগো নিউজ: সাত কলেজের শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণে সরকারের সঙ্গে আলোচনা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো চিন্তা আছে কি না?

মাকসুদ কামাল: শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে, এটা স্বাভাবিক। সাত কলেজের শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য কী কী প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা জানাতে আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমি এরই মধ্যে কথা বলেছি। তিনিও এ বিষয়ে কনসার্ন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সামনের দিনগুলোতে সাত কলেজ থেকে আসা চাহিদা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবো।

জাগো নিউজ: অনেকে মনে করেন অধিভুক্তির পর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন! আপনি কি একমত?

মাকসুদ কামাল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর চাকরির বাজারে যখন ঢাবির সার্টিফিকেট দেখানো হয় সেক্ষেত্রে শুধু দেশে নয় বিদেশেও চাকরি ক্ষেত্রে তারা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পায়। পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করলে সেখানেও তারা গুরুত্ব পাচ্ছে। চাকরির বাজারে আমরা যতদূর জানি ব্যাংক, বিসিএসসহ নানা জায়গায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বাড়তি সুযোগ পাচ্ছে। জেনারেল কনসেপশন হলো- সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় শিক্ষার মানোন্নয়ন হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।

জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বার্ষিক বাজেটের ভিত্তিতে চলে। শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণে সাত কলেজের জন্য সরকারের আলাদা বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না?

মাকসুদ কামাল: শিক্ষার মানোন্নয়ের সঙ্গে আর্থিক বিষয়টিও সরাসরি জড়িত। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো, শ্রেণিকক্ষের আকার এবং সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিরূপণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের বার্ষিক বাজেট আসে ইউজিসি (বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) থেকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ও চলে স্বায়ত্তশাসনে। কিন্তু সাত কলেজ চলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে চাহিদা দিতে আমরা সাত কলেজের অধ্যক্ষদের বলেছি। চাহিদা পাওয়ার পর এ নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবো।

জাগো নিউজ: শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কী পরামর্শ বা উপদেশ আপনার?

মাকসুদ কামাল: আমরা লক্ষ্য করেছি শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ক্লাসবিমুখ। ক্লাসে না এসেও বই পড়ে মুখস্ত বিদ্যায় পাস করা যায়। কিন্তু শিক্ষকরা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে ক্লাসে যে লেকচার দিচ্ছেন সেগুলো শিক্ষার্থীদের জ্ঞানভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করে। সেই জ্ঞান আস্বাদনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর কূটনৈতিক জ্ঞান প্রসারিত হয়। সেজন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ তারা যেন ক্লাসমুখী হয়।

এমকেআর/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।