কুড়িগ্রাম-৩
নির্ভার বিএনপি, ছাড় দিতে নারাজ জামায়াত
তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত উপজেলা উলিপুর। ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর)। দেশের রাজনীতিতে একসময় জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল আসনটি। গত দুই দশকে এ আসনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পালাবদলের রাজনীতি হয়েছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলছে নানান জল্পনা-কল্পনা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগের এ নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত। স্বৈরাচারের দোসর হওয়ায় জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি-না তা নিয়ে দোটানায় পড়েছে। তাই তাদের পক্ষেও এ আসনটি ধরে রাখা কঠিনই হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বিএনপি, তবে হাল ছাড়তে নারাজ জামায়াত।
১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) সংসদীয় আসন হাতছাড়া করেনি জাপা। বিপুলসংখ্যক ভোটব্যাংক থাকায় দলটির প্রার্থীর বিপরীতে সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তবে এরশাদের মৃত্যুর পর সাংগঠনিকভাবে জাপার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে।
ইসলামি দলগুলো যদি জোট হয় আর বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচন করে, আমরা মনে করি উলিপুর বিএনপি এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম নির্বাচন করার মতো আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি তৈরি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে লড়বে এরকম প্রার্থী উলিপুরে নেই।
তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এ কে এম মাঈদুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরে আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে এরশাদের ছোট ভাই মোজাম্মেল হক লালু এমপি হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এ কে এম মাঈদুল ইসলামকে হারিয়ে বিজয়ী হন জাপার প্রার্থী মাওলানা মতিয়ার রহমান। ওই সময় ত্রিমুখী লড়াইয়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তিই জয় এনে দেয় তাকে।
আরও পড়ুন
কিন্তু ২০০৮ সালে দলবদলে জাপার প্রার্থী হয়ে আসনটিতে এমপি হন এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। মহাজোটের অংশ হিসেবে জাপা ও আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে এ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পান জাপা প্রার্থী।
২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মাঈদুল ইসলাম মারা গেলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম এ মতিনকে হারিয়ে জয়ী হন জাপার প্রার্থী ডা. আক্কাছ আলী সরকার। উপ-নির্বাচনের চার মাস পর একই বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নানান নাটকীয়তার পর সে নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন আক্কাছ আলী সরকার। ওই নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ মতিন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবা।
আমার আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবং বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে এসব অভিজ্ঞতা সামনে রেখে আমি সবার জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, মানবিক ও আধুনিক আত্মনির্ভরশীল উলিপুর গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। আমার বিশ্বাস এ আসনটি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যাবে ইনশাআল্লাহ।
জানা গেছে, ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসন। এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৪৭ হাজার ২৬২। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ৫৭০ ও নারী ভোটার এক লাখ ৭৫ হাজার ৬৯১।
আসনটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম ও রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক মনোনয়নপ্রত্যাশী। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ডা. আক্কাস আলী সরকার ও গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট এস. এম. নুরে এরশাদ সিদ্দিকী প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।
ভোটাররা বলছেন, নদীঘেরা এলাকা হওয়ায় প্রতি বছর শত শত ঘরবাড়ি আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বাস্তুহারা হন ভাঙনকবলিত মানুষগুলো। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। বাইপাস সড়কের অভাবে পৌর শহরে যানজট লেগেই থাকে। নির্বাচন এলে এসব সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
এছাড়া উলিপুরে ধান, পাট ও সবজির ফলন ভালো হলেও বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পান না। মাঝখান থেকে ফড়িয়ারা লাভবান হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা হাসপাতালটিতে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই এ উপজেলায়। আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে এসব সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন ভোটাররা।
আরও পড়ুন
গণ অধিকার পরিষদের (জিওপির) উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী অ্যাডভোকেট এস. এম. নুরে এরশাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সমৃদ্ধ উলিপুর গড়ি’ অঙ্গীকার নিয়ে জনগণের পাশে থাকতে চাই, স্থানীয় জনগণের কথা জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে চাই এবং সমস্যা সমাধানের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও স্থানীয় উন্নয়নে কাজ করতে চাই। উলিপুরের নদী রক্ষা ও চর উন্নয়ন আন্দোলন জোরদার করাই হবে আমার মূল লক্ষ্য।
চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, আবার কোথাও থাকলেও ওষুধ নেই, নারীদের চিকিৎসা নেই, গর্ভবতী মায়েদের খুব কষ্ট হয়। মেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারে না। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা। আমরা আর মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করবো না। যারা চরের মানুষের উন্নয়ন করবে আমরা সবাই তাকে ভোট দেব।
ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ও রাবির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহীকে এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াত। ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও সাম্য মানবিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূরণ হয়নি। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান সেই অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমার আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবং বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে এসব অভিজ্ঞতা সামনে রেখে আমি সবার জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, মানবিক ও আধুনিক আত্মনির্ভরশীল উলিপুর গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। আমার বিশ্বাস এ আসনটি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
উলিপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হায়দার আলী মিঞা বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের একটা বৃহৎ রাজনৈতিক এবং জনপ্রিয় দল। বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে অনেকবার। জনগণ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য উৎগ্রীব। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলো যদি জোট হয় আর বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচন করে, আমরা মনে করি উলিপুর বিএনপি এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম নির্বাচন করার মতো আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি তৈরি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে লড়বে এরকম প্রার্থী উলিপুরে নেই। উলিপুরে বিএনপির একক প্রার্থী তাসভীর উল ইসলাম, এটা শুধু সময় আর দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। তবে যদি তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে দল অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচন করে তাহলে বিএনপির জন্য এটা ভুল সিদ্ধান্ত। উলিপুরের নির্বাচনী মাঠ তৈরি হয়েছে তাসভীর উল ইসলামকে কেন্দ্র করে বলেও জানান এ নেতা।
প্রতিবার নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা আসে, নানান প্রতিশ্রুতি দেয়। কেউ বলে নদীভাঙন ঠেকাব আবার কেউ বলে হাসপাতালের উন্নয়ন হবে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হবে। কিন্তু এগুলো সব মিথ্যা আশ্বাস, মূলত কাজের কাজ কিছুই হয় না। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত।
তবে এ আসনে ভোটারদের কাঙ্ক্ষিত আশা-প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় তাদের মাঝে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ রয়েছে। আক্ষেপ করে থেতরাই ইউনিয়নের দঁড়িকিশোরপুরের ভোটার ময়নুল ইসলাম (৪৬) বলেন, প্রতিবার নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা আসে, নানান প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ বলেন নদীভাঙন ঠেকাব আবার কেউ বলেন হাসপাতালের উন্নয়ন হবে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হবে। কিন্তু এগুলো সব মিথ্যা আশ্বাস, মূলত কাজের কাজ কিছুই হয় না। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন
- পিআর পদ্ধতিতে সংসদে সব দলের সুষম অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে: ফয়জুল করীম
- মসজিদের রেলিং ভেঙে মুসল্লির মৃত্যু
সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন সাহেবের আলগার চর ঘুঘুমারীর বাসিন্দা খাদিজা বেগম (৩৮) বলেন, চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, আর কোথাও থাকলেও ওষুধ নেই, নারীদের চিকিৎসা নেই, গর্ভবতী মায়েদের খুব কষ্ট হয়। মেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারে না। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা। আমরা আর মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করবো না। যারা চরের মানুষের উন্নয়ন করবে আমরা সবাই তাকে ভোট দেব।
এমএএনইউ/এসএইচএস/এমএফএ/জেআইএম