যে শহরে প্রতিদিন নষ্ট হয় দুই টন খাবার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৬:০৭ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
পরিবেশনের জন্য হোটেলে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে খাবার/ছবি-জাগো নিউজ
  • প্রতিটি হোটেলে দৈনিক ৫-২০ কেজি খাবার নষ্ট হয়
  • নষ্ট খাবারের বেশিরভাগই ফেলা হয় ডাস্টবিনে
  • অপচয় রোধে ‘ফুডব্যাংক’ চালুর পরামর্শ

বগুড়ায় প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে দুই টনের বেশি রান্না করা খাবার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের শত শত হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড দোকান এমনকি কমিউনিটি সেন্টারে যত খাবার রান্না হয়, তার বড় একটি অংশই শেষ পর্যন্ত যায় ডাস্টবিনে। কোথাও গর্ত করে সেগুলো মাটিচাপা দেওয়া হয়। কোথাও সরাসরি ফেলা হয় নর্দমায়। ফলে শহরে দুর্গন্ধ ও বর্জ্য দূষণ বাড়ছে প্রতিদিন।

বগুড়া শহরে বর্তমানে ছোট-বড় মিলে ৫০০টির বেশি হোটেল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। স্থানীয় হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্যদের তথ্যমতে, প্রতিটি হোটেলে গড়ে ৫-২০ কেজি পর্যন্ত রান্না করা খাবার প্রতিদিন ফেলে দেওয়া হয়। শুধু এই হিসাবেই শহরজুড়ে নষ্ট হচ্ছে প্রায় দুই থেকে আড়াই টন খাবার।

শুধু হোটেল নয়, শহরের ২৫টির বেশি কমিউনিটি সেন্টারে প্রতিদিনই বিয়ে, জন্মদিন বা সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত রান্না করা খাবারের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয় না। আয়োজন শেষে যে খাবার অবশিষ্ট থাকে, তা সাধারণত মাটিচাপা দেওয়া বা ডাস্টবিনে ফেলা হয়।

হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন নষ্ট দুই টন খাবার

বগুড়া পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মচারী আকরাম মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে যে বর্জ্য আসে, তার অন্তত ৬০-৭০ শতাংশই খাবারের। গরমের সময় এগুলো দ্রুত পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এ কারণে নিয়মিত পরিষ্কার করা সত্ত্বেও শহরের কিছু এলাকায় দুর্গন্ধের সমস্যা থেকে যায়।’

কেন এত অপচয়

হোটেল মালিকরা বলছেন, বিক্রির অনিশ্চয়তা, পরিকল্পনার অভাব এবং প্রতিযোগিতার চাপ— এ তিন কারণেই সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয়। গ্রাহকরা হঠাৎ ঢুকে খাবার চান, আবার মুহূর্তেই রুচি বদলে অন্য পদ চান। এই দ্রুত সেবার চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন আগে থেকেই বেশি পরিমাণে রান্না করতে হয়।

বগুড়া শহরের একটি মাঝারি মানের হোটেলের মালিক আব্বাস আলী বলেন, ‘আমরা যদি কম রান্না করি, বিকেলে গ্রাহক এলে দিতে পারবো না। তারা অন্য হোটেলে চলে যাবেন। আবার বেশি রান্না করলে অনেকটাই পড়ে যায়। মাঝামাঝি হিসাবটা মেলানো যায় না।’

আরেক হোটেলের মালিক শুক্কুর আলী জানান, প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫ কেজি ভাত, মাংস, ডাল, সবজি অবশিষ্ট থেকে যায়। কিছু ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রাতের খাবার সকালে গরম করে বিক্রি করলে ক্রেতারা বুঝে ফেলেন। এতে সুনাম নষ্ট হয়। তাই অনেকেই সেটা করেন না।

আরও পড়ুন:
চাল আসল না নকল নিজেই যাচাই করুন
ভাত নাকি রুটি, কোনটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?
সয়াবিন নাকি সরিষা, প্রতিদিনের রান্নায় কোন তেল খাবেন
ভাইরাল ‘কেকপট্টি’ তুলে দেওয়া কি ভালো হলো, নাকি খারাপ
নুডলস আর রামেনের পার্থক্য জানেন কি
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে খাবার রাখা কতটা নিরাপদ?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি হোটেলের মালিক বলেন, ‘বেঁচে যাওয়া খাবার দান করতে চাইলেও সমস্যায় তা সম্ভব হয় না। রাস্তার মানুষকে খাওয়াতে চাই, কিন্তু রাতে দোকান বন্ধের পর ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় খাবার রাখার মতো পরিষ্কার জায়গাও থাকে না।’

হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন নষ্ট দুই টন খাবার

কথা হয় বগুড়া জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক কেজি ভাত তৈরি করতে প্রায় তিন লিটার পানি লাগে। ভাবুন, প্রতিদিন যদি দুই টন খাবার নষ্ট হয়, তাহলে তার সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে হাজার লিটার পানি, গ্যাস বা জ্বালানি আর শ্রম। এটা কেবল খাবারের অপচয় নয়, পুরো সম্পদচক্রের অপচয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক হোটেলে সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। অতিরিক্ত রান্না করা খাবার ঠান্ডা রাখার বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপায়ে সংরক্ষণের মতো ফ্রিজ বা কোল্ড রুম নেই। ফলে খাবার দ্রুত পচে যায় এবং পরদিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনার অভাব, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং গ্রাহকের রুচি—এ তিন কারণেই প্রতিদিন বগুড়ায় নষ্ট হচ্ছে দুই টনের বেশি রান্না করা খাবার।

সমাধান ‘ফুড ব্যাংক’

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, ‘এটা শুধু পরিবেশের বিষয় নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতারও প্রশ্ন। হোটেলগুলোর সঙ্গে পৌরসভা বা স্থানীয় এনজিও যৌথভাবে ‘ফুড ব্যাংক’ চালু করতে পারে। দিন শেষে যেসব খাবার ভালো অবস্থায় থাকে, সেগুলো দ্রুত সংগ্রহ করে দরিদ্র মানুষ, পথশিশু বা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিতরণ করা যেতে পারে। এতে একদিকে খাদ্যের অপচয় রোধ হবে, অন্যদিকে অসহায় মানুষদের উপকার হবে।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) সম্পাদক কে জি এম ফারুকের মতে, খাবার অপচয় রোধে হোটেলগুলোকে রান্না করা খাবার, পচনশীল বর্জ্য এবং শুকনা বর্জ্য আলাদা রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। পৌরসভা বা এনজিওগুলো সন্ধ্যার পর হোটেল ও রেস্তোরাঁ থেকে ভালো খাবার সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণ করতে পারে এবং খাবার রাতে আশ্রয়কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম অথবা রাস্তার গরিব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। পচনশীল অংশগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে পশুখাদ্য বা জৈব সার তৈরিতে।

বগুড়া পৌরসভার কর্মকর্তারা বলছেন, চাইলে শহরের কিছু ওয়ার্ডে পরীক্ষামূলকভাবে এমন প্রকল্প শুরু করা সম্ভব। তারা মনে করেন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিকদের সহযোগিতা পাওয়া গেলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অনেক সহজ হবে।

এনজিও খাতে কাজ করা কয়েকজন জানান, ঢাকায় এরইমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ফুড ব্যাংক প্রকল্প চালু করেছে, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বগুড়ায় এমন উদ্যোগ চালু হলে তা উত্তরাঞ্চলের জন্য মডেল হতে পারে।

খাবার বর্জ্য থেকে প্রতিদিন প্রচুর মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই খাবার যদি সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়, তাহলে শহরের পরিবেশও অনেকটা নিরাপদ হবে বলে জানান পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মাসুদ রানা ।

তিনি বলেন, ‘বগুড়ার মতো শহরে যদি প্রতিদিনের নষ্ট হওয়া দুই টন খাবারের অর্ধেকও কাজে লাগানো যায়, তাহলে একদিকে ক্ষুধার্ত মানুষদের মুখে খাবার পৌঁছাবে, অন্যদিকে শহরের বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণও অনেকটা কমে আসবে। কারণ প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার ডাস্টবিনে যাচ্ছে, তা দিয়ে অন্তত এক হাজার থেকে দেড় হাজার মানুষ একবেলা পেট ভরে খেতে পারত। অথচ শহরের হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় সেই খাবারই এখন পচে গিয়ে আবর্জনায় মিশছে। কেউ হয়তো বুঝতেও পারছেন না এই অপচয়ের প্রতিটি দানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একেকজন শ্রমিকের ঘাম, কৃষকের পরিশ্রম আর এক ফোঁটা করে পানি ও জ্বালানির খরচ।’

খাদ্য অপচয় কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটা মানবিক ব্যর্থতা বলে মনে করেন এনজিওকর্মী আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, ‘যখন শহরের ফুটপাতে ক্ষুধার্ত মানুষ রাত কাটায়, একই শহরে কয়েক টন খাবার ডাস্টবিনে ফেলা হয়, তখন সেটা শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, নৈতিক দায়িত্বীনতাও।’

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।