স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার দাবি

আঁধার কাটিয়ে প্রাণের আলোয় রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক রংপুর
প্রকাশিত: ০১:৫৪ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫

বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে গড়ে ওঠা স্মৃতিকেন্দ্রটি ঘিরে আশার আলো জাগছে। দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে আজ চালু হচ্ছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন। ফলে আঁধার কেটে স্মৃতিকেন্দ্রে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে। তবে কারও সঙ্গে যৌথভাবে নয়, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হবে এমনটাই দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেগম রোকেয়ার জীবন, কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে ২০০১ সালে গড়ে তোলা হয় এই স্মৃতিকেন্দ্র। মিলনায়তন, সেমিনারকক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র মিলে বেশ সমৃদ্ধ এটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় সোয়া ৩ একর জমিতে পৌনে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিকেন্দ্রটি। যা ২০০১ সালের ১ জুলাই উদ্বোধন করার পর রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উপ-পরিচালকসহ ১৩ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এ প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায় এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে যায় স্মৃতিকেন্দ্রটি। ভেস্তে যায় রোকেয়ার জীবন কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ ও সংস্কৃতি চর্চা। বেতন ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন শুরু হয় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্মৃতিকেন্দ্রে শুরু হয় বিকেএমই’র পোশাক শ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ২০০৮ সালে পোশাক শ্রমিক তৈরির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান। পরে মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে তোলা স্মৃতি কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত করে সেখানে বিকেএমইএর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ এবং উচ্ছেদ করার জন্য হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট করে। এরই প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট স্মৃতি কেন্দ্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিকেএমই’র কারখানা বন্ধের আদেশ দিলে মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসন ওই বছরের ১ মে বিকেএমইএর কারখানা উচ্ছেদ করে।

পরবর্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্মৃতিকেন্দ্রটি নিয়ে টানাটানি শুরু হলে একদিকে স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে মানবেতর সময় পার করতে থাকেন নিয়োগকৃত উপ-পরিচালকসহ অন্যরা। এক পর্যায়ে তৎকালীন উপ-পরিচালক আব্দুল্যা আল ফারুক উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন। এরই ফলশ্রুতিতে আদালত ২০১৫ সালের ১৭ মে উপ-পরিচালকসহ ৬ জনের চাকরি রাজস্বখাতে নেওয়ার পাশাপাশি স্মৃতিকেন্দ্রটি চালুর নির্দেশ দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে।

আঁধার কাটিয়ে প্রাণের আলোয় রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

এদিকে রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করলে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। তবুও আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় স্থবির হয়ে পড়ে স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম। ২০১৯ সালের দিকে এখানে সীমিত পরিসরে সংগীত, চিত্রাঙ্কনসহ কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। এরপর করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের দিকে আবারো সংগীত কোর্স চালু করলেও সেটি বেশি দিন চালানো সম্ভব হয়নি।

এদিকে রোকেয়ার জন্মভিটা দেখতে এসে ক্ষুব্ধ দর্শনার্থীরাও। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের কমতি নেই। তারা বলছেন, রোকেয়ার স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও পড়ে আছে অবহেলায়। সরকারের সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে এখনো রোকেয়া চর্চা ও সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রের দ্বার রুদ্ধ। উদ্ধার হয়নি বেহাত হওয়া সম্পত্তি, মসজিদ, দিঘীসহ কোনো কিছুই। আঁতুর ঘরটিও হয়নি সংস্কার।

স্মৃতিকেন্দ্র দেখতে আসা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুর রহমান বলেন, গত দু’বছর ধরে বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়েনি।

স্থানীয় আজাদ হোসেন বলেন, নানা অবকাঠামো দিয়ে সজ্জিত স্মৃতিকেন্দ্রটি সাজানো হলেও নেই কোনো কার্যক্রম। ভবনের প্রায় সব কক্ষই তালাবদ্ধ। বেশিরভাগ কক্ষের দরজা, জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। অবকাঠমো আছে, জনবল আছে, নেই শুধু কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ। সরকার এত বড় অবকাঠামো কেন অযত্ন-অবহেলায় ফেলে রেখেছে জানি না। আমরা চাই এই স্মৃতিকেন্দ্রে বছরব্যাপী নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক। আমরা যেন ঘুরতে এলে এখানে ভুতুড়ে পরিবেশ না পাই।

রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, আমরা ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার এ স্মৃতিকেন্দ্রের উন্নয়ন করবে, কার্যক্রম চালু করতে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি।

স্মৃতিকেন্দ্র ঘিরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলা একাডেমির সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। তবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সমঝোতা স্মারক সই করতে পারেন না। এটা করলে উচ্চ আদালতের রায় অবমাননা করা হবে।

দুলাল বলেন, নজরুল ইনস্টিটিউট, লালন একাডেমি, রাজশাহীতে উপজাতীয় ভাষা ইন্সিটিউটের মতো রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটিও একটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকবে, এটা আমাদের দাবি।

যদি তারা সমঝোতা স্মারক সই করে তাহলে এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, হাইকোর্ট থেকে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও ও ওসির প্রতি স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, যেন কোনোভাবেই বেগম রোকেয়ার মর্যাদা ও সুনাম ক্ষুণ্ন না হয় এবং এই স্মৃতিকেন্দ্র যেন কেউ কোনোভাবেই দখল করতে না পারে। এরপরও যদি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সমঝোতা স্মারক সই করে তাহলে আমরা আদালতে যাবো।

স্মৃতিকেন্দ্রে রয়েছে বেগম রোকেয়ার একটি ম্যুরাল, ২৬০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন, ১০০ আসনের সেমিনার কক্ষ, ১০ হাজার পুস্তক ধারণক্ষমতার লাইব্রেরি, চার হাজার বিভিন্ন বইপত্র-পত্রিকা, গবেষণাকেন্দ্র, সংগ্রহশালা, ২৫টি সেলাই মেশিনসহ একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। সেইসঙ্গে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যালয় ও উপপরিচালকসহ কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা। সামনে স্থাপন করা হয়েছে পিতলের তৈরি বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য।

বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক ও বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবিদ করিম মুন্না বলেন, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম চলছে। আজ ৯ ডিসেম্বর থেকে এখানে শিশুদের চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন হবে। এছাড়া রোকেয়ার জীবনের ওপর বই নিয়ে লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলা একাডেমির সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আবিদ করিম মুন্না বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

নারী জাগরণের অগ্রদূত ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামের এক সভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। তার বাবা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার, মা রাহাতুন্নেছা সাবের চৌধুরানী। খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে অল্প বয়সে বিয়ে হয় রোকেয়ার। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি স্বামীকে হারান। তার জীবদ্দশায় অবরোধ বাসীনি, অর্ধাঙ্গী, সুলতানার স্বপ্ন, মতিচুর ছাড়াও অসংখ্য বই লিখেছেন বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি কোলকাতায় মারা যান। কোলকাতার শোদপুরে সমাহিত করা হয় রোকেয়াকে।

জিতু কবীর/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।