ধান কাটা শ্রমিক যেন সোনার হরিণ!

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নড়াইল
প্রকাশিত: ০৪:২০ এএম, ০৮ মে ২০১৭

‘ভাই, একটু কমে চলেন। ৮০০ টাকা চেয়েছেন, সাড়ে ৭০০ টাকা নিয়েন। মাত্র ৫০ টাকার ব্যবধান। চলেন না ভাই।’ এই দর কষাকষি শ্রমিক বেচাকেনার। দু’জন শ্রমিকের জন্য প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলছে এই দর কষাকষি। তবুও নিষ্ফল আবেদন। বাধ্য হয়ে ৮০০ টাকায় শ্রমিক কিনে বাড়ি ফিরলেন লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের ফাইজার মোল্যা।

শ্রমিক বেচাকেনার এ দৃশ্য নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার এড়েন্দা হাটের। শুধু ফাইজার মোল্যা নয়, তার মতো শত শত কৃষক ছুটছেন শ্রমিকের পেছনে। আর শ্রমিকেরা ছুটছেন মোটা অঙ্কের টাকার দিকে।

ধানকাটা মৌসুমে শ্রমিক পাওয়া যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়া বলে মন্তব্য করেছেন কৃষকেরা। একদিনের জন্য জনপ্রতি ৮০০ টাকা শ্রমমূল্য দেয়ার পাশাপাশি ওই শ্রমিককে তিনবেলা খাবার ও ধূমপায়ীদের বিড়ি দিতে হচ্ছে।

এক্ষেত্রে জনপ্রতি আরো ১৫০ টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। একসঙ্গে বেশির ভাগ ধান পেকে যাওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হঠাৎ করে শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে গেছে। এদিকে হাটবাজারে প্রতিমণ নতুন বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকায়।

norail

কালিয়া উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের আবু সাঈদ বলেন, প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে এড়েন্দা হাটে জন (শ্রমিক) নিতে এসেছি। ৮০০ টাকার কমে কেউ যেতে চান না। সেই সঙ্গে যাতায়াত ভাড়া তো আছেই। একজন কৃষক আড়াই মণের বেশি ধান কাটতে পারেন না। এতো দামের কারণে ‘জন’ নিতে পারছি না।

তিনি আরো বলেন, এতো বেশি শ্রমমূল্য এবং উৎপাদন খরচ মিলিয়ে একমণ ধান বিক্রি করলে তেমন কিছুই থাকে না। আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব?

একই এলাকার আবুল বাশার বলেন, ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে ধান মাটিতে পড়ে গেছে। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে পারছি না। তারা (শ্রমিক) কেউ ৮০০ টাকার কমে নিতে রাজি না। কী যে সমস্যায় পড়েছি! অথচ, ধান লাগানো এবং পরিচর্যার সময় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় শ্রম বিক্রি হয়েছে।

নড়াইল সদরের তুলারামপুর গ্রামের ইশতিয়াক জানান, একজন শ্রমিক একদিনের শ্রমঘণ্টায় দুই থেকে তিন মণ ধান কাটতে পারেন। তবে এই সময়ের মধ্যে জমি থেকে বাড়িতে ধান এনে মাড়াই করতে পারেন না। এজন্য আরো অতিরিক্ত সময় ও শ্রম প্রয়োজন হয়। তবুও উচ্চমূল্যে শ্রমিক কিনতে হচ্ছে।

কৃষক নেতা খন্দকার শওকত বলেন, সপ্তাহ খানেকের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে নড়াইলে পুরোদমে ধানকাটা শুরু হলেও শ্রমিক সংকট ও উচ্চমূল্যের কারণে কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। ‘শ্রমিক সংকট’ ধানকাটার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পাট নিড়ানিরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই ‘শ্রমিক বা জন’ পাওয়া যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গেছে।

norail

লোহাগড়ার এড়েন্দা হাটে শ্রমবিক্রি করতে আসা কালিয়া উপজেলার বাগুডাঙ্গা গ্রামের আসলাম সিকদার জানান, সাড়ে ৭০০ টাকা দর হয়েছে। তবে ৮০০ টাকার কমে যাবেন না।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা গ্রামের শরিফুল ইসলাম জানান, তারা তিনজন পাট নিড়ানির জন্য শ্রমবিক্রি করতে এসেছেন। ভালো দাম না পেলে তারা কাজে যাবেন না।

নড়াইল সদরসহ কালিয়া ও লোহাগড়া উপজেলার অন্যান্য হাটবাজারেও উচ্চ মূল্যে ধানকাটা শ্রমিক বেচাকেনা চলছে। কোথাও কোথাও শ্রমিক না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন কৃষকেরা। শ্রমিক না পেয়ে প্রয়োজনের তাগিদে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ধানকাটা ও মাড়াইয়ের কাজে সময় দিচ্ছে। এ কারণে বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে। বিশেষ করে ছাত্রদের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নড়াইলের উপ-পরিচালক শেখ আমিনুল হক জানান, ঝড় ও বৃষ্টিতে ধানের কিছুটা ক্ষতি হলেও বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। এ বছর নড়াইলে ৪১ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।

হাফিজুল নিলু/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।