জলের বুকে একজন জেলের গল্প

১৯৬১ সালে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এ হ্রদ তৈরি করা হলেও মৎস্য আহরণসহ নানা রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান এ হ্রদকে ঘিরেই। জেলার প্রায় ৯ হাজার নিবন্ধিত জেলের জীবন জীবিকা এ হ্রদের জলেই বহমান।
আমরা আজ পাঠককে একজন সাধারণ জেলের গল্প জানাতে চাই। তোতা মিয়া নামের প্রান্তিক এ জেলে অন্যান্য জেলেদের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। বেশি রোজগারের আশায় সব জেলেরা যখন সন্তানদের মাছ ধরতে নামিয়ে দেয়, তোতা মিয়া তখন তার চার সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠায়।
তোতা মিয়ার বাড়ি লংগদু উপজেলার কালাপাকুজ্যা ইউনিয়নের ছালামপুর গ্রামে। এক সময় কৃষি কাজ করলেও বর্তমানে মাছ ধরাই তার পেশা। ছোট্ট একটি নৌকা আর জাল নিয়ে কাপ্তাই হ্রদের কাট্টলি বিলে সারা সপ্তাহজুড়ে মাছ ধরেন তিনি।
কেমন রোজগার হয় জানতে চাইলে তোতা মিয়া বলেন, শীতে মাছ কম পড়ে বাজান। হারা হপ্তাহে দুই থেকে আড়াই হাজার টেকা পাওন যায়। তয় শীত গেলে আবার চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টেকাও রোজগার অইবো।
মাছ ধরে সওদাগরদের নৌকায় দিয়ে দেন। হিসাব মেলে সপ্তাহ শেষে শনিবারে হাটের দিন। এ দিনই বাজার সদায় করে বাড়িতে স্ত্রীর কাছে দিয়ে আবারও ফিরে যান বিলে। নিজের খাওয়া দাওয়া, ঘুম সবই চলে নৌকায়। সারারাত জাল ফেলে মাছ ধরেন। সকালে কূলে ভেড়ান নৌকা। এরপর রান্না বান্না খাওয়া এবং ঘুম। এ যেন জলে ভাসা জীবন।
তোতা মিয়া ছয় সন্তানের মধ্যে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে চারজনই পড়ালেখা করছে। বড় ছেলে রফিকুল ইসলাম স্থানীয় কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। এক মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এক ছেলে আগামীতে এসএসসি দেবে। আর এক মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ছে। পড়ালেখার ক্ষেত্রে দুই ছেলে মেয়ে উপবৃত্তি পেলেও বাকিদের ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা পান না তোতা মিয়া।
কথা বললে বলতে বেরিয়ে এলো আরও অনেক তথ্য। প্রতিরাতে শুধুমাত্র কাট্টলি বিলেই নামে ২ হাজার ছোট নৌকা। আর বড় নৌকা এবং বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জেলেরাতো আছেই। তোতা মিয়ার খুব কষ্ট হয় বর্ষা মৌসুমে। নৌকায় ছাউনি নেই তাই বৃষ্টিতে ভিজেই চলে মাছ ধরা। নৌকায় কেন ছাউনি নাই জানতে চাইলে তোতা মিয়ার উত্তর ‘বাজান ছাউনি দিলে একজনে অইব না তহন দুইজন লাগবো’।
এমন অল্প রোজগারে খুব টানাপোড়েন সংসারে। তবুও সন্তানদের পড়াশোনা থামাতে চান না কখনও। সন্তানরা পড়ালেখা করে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবেন, একদিন সকল দুঃখ কষ্ট হ্রদের জলেই ধুয়ে মুছে আসবে নতুন দিন। সেইদিনের অপেক্ষায় আজও জলের বুকে বেয়ে চলে জীবন যুদ্ধের নাও।
এমএএস/আরআইপি