এটা আমার অফিস, আমি যা ইচ্ছা তাই করব

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০২:২৩ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সাংবাদিক দেখলেই ক্ষেপে যান গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরুন্নবী সরকার। মুখে যা আসে তাই বলেন। নামে-বেনামে সরকারি সম্পদ লুট করার খবর বারবার প্রকাশ করায় অফিসে সাংবাদিক গেলেই চড়াও হন তিনি। উগ্রভাবে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। জোর গলায় বলেন, এটা আমার অফিস, আমি যা ইচ্ছা তাই করব।

বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে আরও একটি মামলাসহ থানায় জিডি আছে একাধিক। টিআর-কাবিখায় গৃহ নির্মাণসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের হিসেব নেই পিআইও নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের তদন্তে বেশকিছু প্রমাণও মেলে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই এই সরকারি কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা।

২০১৫ সালের শুরুতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে (পিআইও) যোগ দেন নুরুন্নবী সরকার। শুরু থেকেই সরকারি বরাদ্দের টিআর, কাবিখাসহ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করেই অর্থ উত্তোলনসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্যে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার নদীভাঙন ও দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ আসে নগদ টাকাসহ ৫২০ বান্ডিল ঢেউটিন। এর মধ্যে তিনি ২০০ বান্ডিল আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর সেই ঢেউটিন উদ্ধার করা হয় একটি মাদরাসা থেকে। এ ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল মালেক তদন্ত করে সত্যতাও পান। টিন আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় পিআইওর বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন রংপুর সমন্বিত দুদকের এক কর্মকর্তা।

এছাড়া একই বছর সুন্দরগঞ্জ রিপোর্টার্স ক্লাবের উন্নয়ন ও একটি রাস্তা সংস্কারে টিআর-কাবিখা প্রকল্পের আওতায় নগদ টাকা ও ৫ টন চাল বরাদ্দ হয়। কিন্তু ভুয়া প্রকল্প কমিটি দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করেন পিআইও নুরুন্নবী সরকার। পরে তদন্তে এ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এছাড়া ২০১৬ সালের ৩ মার্চ ব্রিজের কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মেসার্স নিশা কনস্ট্রাকশনের ঠিকাদার ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ছামিউল ইসলাম সামুর কাছ থেকে কয়েকজনের উপস্থিতিতে ১২ লাখ টাকা ঘুষ নেন নুরুন্নবী। কিন্তু সেই কাজ তাকে না দিয়ে অন্য ঠিকাদারকে দেয়া হয়। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও সোলার প্যানেল স্থাপন প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা কাজ না করেই ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন পিআইও নুরুন্নবী ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় পিআইওসহ আটজনের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই দুদক সমন্বিত রংপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোজাহার আলী বাদী হয়ে এ মামলা করেন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের টিআর-কাবিখার বিশেষ বরাদ্দের দুই কোটি ২৮ লাখ টাকার কাজ ঠিকমত না করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে পিআইও নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সোলার স্থাপন, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা সংস্কার এবং গৃহনির্মাণ প্রকল্পেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অপরদিকে সরকারি বরাদ্দের টিআর-কাবিখা ও গৃহনির্মাণসহ ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করেই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে ৬ কোটি টাকার বিল দাখিল করেন নুরুন্নবী। কিন্তু সেই বিলে স্বাক্ষর করেননি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক। এ কারণে তাকে চাপ প্রয়োগসহ গালিগালাজ করেন নুরুন্নবী। এক পর্যায়ে হুমকি দিয়ে বিলে স্বাক্ষর নেয়ায় নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে গত ২৯ জুন সুন্দরগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরিসহ ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।

এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) পিআইওর কার্যালয়ে যান স্থানীয় সাংবাদিকরা। অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তেজিত হয়ে উঠেন নুরুন্নবী। সাংবাদিকদের অপমান-অপদস্ত করেন। এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের হাতে ক্যামেরা দেখে আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। 

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ছোলেমান আলী জানান, পিআইও নুরুন্নবীর এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ও গত জুন ক্লোজিংয়ে কাজ না করে ৬ কোটি টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া অতীত অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতর তার বিরুদ্ধে নেবে।

এদিকে পিআইও নুরুন্নবী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও অর্থ আত্মসাতের মামলার বিষয়ে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগেই পিআইওর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু কেন তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তা জানা নেই। দ্রুত এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখাসহ সংশ্লিষ্ট দফতরকে জানানো হবে।’

জাহিদ খন্দকার/এমএমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।