পুলিশে অভিযোগ করায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে একটি পরিবারকে সমাজচ্যুত
করোনা পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ যখন আতঙ্কিত ঠিক সেই মুহূর্তে ঝিনাইদহের মহেশপুরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে একটি পরিবারের ৩১ সদস্যকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাদের একঘরে করার ঘোষণা দিয়ে গ্রামের কাউকে ওই পরিবারের সঙ্গে না মেশার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কেউ ওই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মিশলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) এ ঘোষণা দেওয়া হয়। আজ সোমবার পর্যন্ত লুৎফর রহমানের পরিবারটি একঘরে অবস্থায় রয়েছে।
পরিবারটির সদস্যরা বলছেন, এ ঘোষণার প্রথম দিন গ্রামের কেউ তাদের সঙ্গে বসতে বা কথা বলতে চাননি। গ্রামের দোকানগুলোতে গেলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দোকানিরা জানিয়ে দিয়েছেন তোমাদের বসতে দিলে সমস্যা হবে। বর্তমানে তারা কিছুটা চলাফেরা করতে পারলেও লোকজন দেখে ফেলতে পারে এমন পরিবেশে কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না। ঘটনাটি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার পান্তাপাড়া ইউনিয়নের মথুরানগর গ্রামের।
ওই গ্রামের বাসিন্দা মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে মনিরুল ইসলাম জানান, তারা ৭ ভাই। স্ত্রী সন্তান মিলিয়ে ৩১ সদস্যের পরিবার। সবাই দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করেন। তাদের একখণ্ড জমি নিয়ে গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ কিছুদিন থেকেই বিরোধ চলে আসছিল, যা বর্তমানে প্রশাসন পর্যন্ত গড়িয়েছে।
তিনি জানান, জমি নিয়ে বিরোধ কিছুতেই যখন মেটে না তখন তারা স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ কয়েকজনের কাছে যান। তারা সবকিছু খুলে বলে একটা সমাধান চেয়েছেন। এরপর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসেনের কাছে যান। পরে যান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ময়জউদ্দিন হামিদের কাছে। কোনো সমাধান না পেয়ে মহেশপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। থানা পুলিশ বিষয়টি দেখবেন বলে তাদের অবহিত করেছেন।
মনিরুল ইসলাম আরও জানান, লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর ২১ এপ্রিল তাদের গ্রামের লোকজন স্থানীয় পান্তাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসেনের কাছে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে দুপুর ১২টার দিকে মাইকযোগে ঘোষণা করেন গ্রামের বাসিন্দা মৃত লুৎফর রহমানের পরিবারকে একঘরে করা হলো। এখন থেকে তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আদেশক্রমে পান্তাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসেন।
ওই পরিবারের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারেক আজিজ জানান, মাইকে ঘোষণার পর তিনি নিজে গ্রামের একটি দোকানে থাকা বেঞ্চে বসতে গিয়েছিলেন। তাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে তাকে বসতে দিলে সমস্যা হবে। গ্রামের একজনের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। বলা হয়েছে তার সঙ্গে মিশলে বিপদ হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্রামের লোকজন তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, তবে সেটা যেন কেউ দেখে না ফেলে। এ অবস্থায় তারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি আরও জানান, গোটা ঘটনা নিয়ে তারা মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এ ঘটনায় মাইকে ঘোষণা দেয়া ব্যক্তি মথুরানগর গ্রামের সফি উদ্দিন জানান, গ্রামের কোনো কিছু প্রচার করতে হলে তা তিনিই করেন। এ ঘটনাও তেমনই হয়েছে। গ্রামের লোকজন তাকে প্রচার করতে বললে তিনি মসজিদের মাইকে প্রচার করেন।
তিনি বলেন, এ প্রচারের পর বিষয়টি নিয়ে তাকে কেউ কিছু বলেনি বলে জানান।
গ্রামের ইউপি মেম্বার মো. কায়দার আলী জানান, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের বিরুদ্ধে লুৎফর রহমানের ছেলেরা। যে কারণে গ্রামের মানুষ উত্তেজিত হয়ে একঘরে করার কথা বলছিল। এমন সময় একটি ছেলে মাইকে প্রচার করে ফেলেছে। পরে তাকে বকাবকিও করা হয়েছে। তবে প্রচার করা বিষয়টি প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি জানান, একটি সমাধান না হলে কীভাবে পাল্টা প্রচার করা যায়।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসেন জানান, ঘটনাটি প্রথমে তাকে অবহিত করলে তিনি করোনা পরিস্থিতির পর সমাধান করে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ওই পরিবারের লোকজন তা না মেনে থানায় অভিযোগ করেছেন। এটা জানার পর গ্রামের লোকজন উত্তেজিত হয়ে নানা কথা বলেন। এ সময় একটি ছেলে হঠাৎ করে মসজিদের মাইকে প্রচার করে ফেলেছেন। যেখানে তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। উল্টো যে প্রচার করেছেন তাকে বকাঝকা করেছেন বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। ওই পরিবারের সদস্যরা সবার সঙ্গে মিশছেন বলে জানান। দ্রুতই একটা সমাধান করে দেবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুজন সরকার জানান, তিনি একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এখনও সমাধান না হওয়ায় তিনি দেখবেন বলে জানান।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এমএএস/এমএস