‘মানবতার গাড়ি, ভালোবাসার টানে যাবে মধ্যবিত্তের বাড়ি’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফেনী
প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ০৪ মে ২০২০

‘মানবতার গাড়ি, ভালোবাসার টানে যাবে মধ্যবিত্তের বাড়ি’ স্লোগানে ছুটে চলছেন তরুণ সমাজকর্মী আমের মক্কি। করোনায় শহরের অলিগলি পেরিয়ে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘ভালোবাসার উপহার’ নিয়ে তিনি ছুটে চলছেন সহযোগী বন্ধুদের নিয়ে। করোনা পরিস্থিতিতে মানবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সচেতনতা সৃষ্টিতেও কাজ করছেন এই তরুণ। বন্ধুদের নিয়ে রাতের আঁধারে শহরের ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোকে খাবার দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আমের মক্কি।

প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন মক্কি। ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে সোনাগাজীর আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি দাখিল পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে অজ্ঞাতরা চুন নিক্ষেপ করে চোখ-মুখ ঝলসে দেয়। প্রতিবাদে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্দনের আয়োজন করেন মাধ্যমিকে পড়া আমের মক্কি। সেই থেকে মানবিক আমের মক্কির যাত্রা শুরু।

makki

এরপর বন্ধুদের নিয়ে সফলতার সঙ্গে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি সম্পন্ন করেন আমের মক্কি। মিরাজ নামের এক যুবকের পায়ের চিকিৎসার জন্য শহরের পথে প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন আমের মক্কি। প্রায় তিন লাখ টাকা সংগ্রহ করে তার পরিবারের হাতে তুলে দেন মক্কির বন্ধুরা। তীব্র গরমে শহরের দিনমজুর ও রিকশাওয়ালাদের মধ্যে খাবার স্যালাইনও বিতরণ করে মানবিক পথে এগিয়ে চলার পথ সুগম করেন মক্কি। কোনো সংগঠনের একীভূত না হয়েও নিজ উদ্যোগে একের পর এক মানবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একাধিক নারী-শিশুর চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে নিজে দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন মক্কি ও তার বন্ধুরা।

২০১৮ সালের কোন একদিন শহরের স্টেশন রোডে মক্কির সঙ্গে দেখা হয় প্রতিবন্ধী রোজিনা বেগমের। তিনি প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মক্কি তাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সাহায্যের আবেদন করে পোস্ট দিলে এগিয়ে আসেন অনেকে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে মক্কি নিজ দায়িত্বে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে ওই নারীর গ্রামে একটি ঘর তৈরি করে দেন। ভিক্ষা নামক অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য তাকে একটি সেলাই মেশিনও কিনে দেন মক্কির বন্ধুরা।

makki

ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়ায় বাক প্রতিবন্ধী আয়েশা আক্তারের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে তো দূরের কথা বাবাহীন অসহায় ওই পরিবারের দুই বেলা খাবারই জোটে না। বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পান মক্কি। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিজে থেকে ধুমদাম করে বিয়ের আয়োজন করেন মক্কি ও তার বন্ধুরা। তারা ওই বিয়েতে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা খরচ করেন।

এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি করোনাভাইরাস। গত মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগি শনাক্ত হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মাঝে। এ দুর্যোগে এগিয়ে আসেন মানবিক মক্কি। ২৪ মার্চ দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলে করোনায় অসহায় মানুষের সহযোগিতার জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন মক্কি। ২৭ মার্চ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ফেনী শহরের কাঁচাবাজার, মুদি দোকান ও ওষুধ দোকানের সামনে বৃত্ত আঁকেন মক্কিসহ তার বন্ধুরা। এ কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন ফেনী মডেল থানার ওসি আলমগীর হোসেন।

makki

২৯ তারিখ থেকে মক্কির মানবিক কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথমদিকে শহরের অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সাধারণ ছুটি বাড়তে থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও খাদ্য সংকটে পড়ে। পরে মক্কি মধ্যবিত্তদের জন্য খাদ্য সরবরাহ শুরু করেন। শহরের গন্ডি ছাড়িয়ে শহরতলীর আশপাশ ও ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ, ধর্মপুর, কালিদহ, ধলিয়া, মোটবী, বালিগাও ইউনিয়ন, দাগনভূঞার জায়লস্কর, ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, শুভপুর এবং পরশুরামের বাউরখুমা এলাকায় রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মক্কি ‘ভালোবাসার উপহার’ পৌঁছে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৯৭ জনকে মক্কি ও তার বন্ধুরা তাদের ভালোবাসার উপহার তুলে দিয়েছেন।

মক্কির সঙ্গে সার্বক্ষণিক ছায়ার মতো লেগে থেকে সহযোগিতা করে আসছে জাবের, আমির, বাবলু, মোহন, মেহেদী ও মাসুদ। তার প্রায় সবগুলো কর্মসূচিতে এ বন্ধুরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে আসছেন। এছাড়াও সাংবাদিক আসাদুজ্জামান দারা, আতিয়ার সজল তাকে নানাভাবে তাকে সহযোগিতা করছেন।

মক্কির উপাখ্যান এখানেই শেষ নয়। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে যাওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে পথের কুকুর। ৩ এপ্রিল থেকে নিজ অর্থায়নে শহরের ট্রাঙ্ক রোড, মিজান রোড়, শহীদ শহিদুল্লা কায়সার সড়ক ও কলেজ রোড এলাকায় ক্ষুধার্ত কুকুরকে রান্না করা খাবার দিচ্ছেন মক্কি। মানবিক কর্মসূচি খাদ্য বিতরণের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে রাতে এ কাজটি করছেন।

makki

ফেনীর সমাজকর্মীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান আমের মক্কি। বাড়ি ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুরে হলেও থাকেন ফেনী শহরের পাঠানবাড়ি এলাকায়। মুসলিম উদ্দিন ও শিরিন আক্তারের চার ছেলে দ্বিতীয় আমের মক্কি। ছেলের এমন মানবিক কর্মকাণ্ডে খুশি হলেও সবসময় ভয় তাড়া করে মুসলিম উদ্দিনকে।

তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ছেলেদের নিয়ে সৌদি আরবে অবস্থান করেছি। সততার সঙ্গে চলার চেষ্টা করেছি। তাই ছেলেদেরও সততার সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছি। মক্কি মানুষের পাশে থেকে সহযোগিতার চেষ্টা করছে। করোনা পরিস্থিতিতে সবাই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করলেও সে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে সহযোগিতা নিয়ে। আমি দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া চাই।

এ বিষয়ে আমের মক্কি বলেন, আমি মানুষের ‘ভালোবাসা’ মানুষের কাছে পৌঁছে দিই। সচ্চতার সঙ্গে কাজগুলো করি বলে মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে। যে কোনো সময় সহযোগিতা চাইলে মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের সহযোগিতা একটি ফান্ড গঠন করেছি। ওই ফান্ড থেকে এখন পর্যন্ত ৯৭ জনকে উপহার তুলে দিয়েছি। আরও বেশ কিছু টাকা আছে। আশা করছি করোনা পরিস্থিতি যতদিন থাকবে ততদিন মানুষের পাশে থাকতে পারবো।

রাশেদুল হাসান/আরএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।