কক্সবাজারে মানুষের উদাসীনতায় বাড়ছে করোনা সংক্রমণ
কক্সবাজারে ক্রমেই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। শহর ছাড়িয়ে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে করোনার তীব্রতা। সরকারের তরফ থেকে সচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও মানুষের উদাসীনতায় জেলায় প্রতিদিনই করোনা পজিটিভ রোগীর সন্ধান মিলছে।। ফলে বাড়ছে উদ্বিগ্নতা।
রোগী বাড়ার পাশাপাশি করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যাও দীর্ঘ হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (২১ মে) রাত পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে কক্সবাজারে নারীসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫৮ জন করোনা রোগী।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের ৫১তম দিনে পরীক্ষার আওতায় এসেছে ৪ হাজার ৭৬৭ জন সন্দেহজনক রোগী। এদের মধ্যে করোনা পজিটিভ এসেছে ৩৪৩ জনের। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলার ৩১৪ জন করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। শুক্রবার (২২ মে) একদিনেই করোনা পজিটিভ এসেছে ৮ রোহিঙ্গার। ফলে সব মিলিয়ে ২১ রোহিঙ্গার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ল। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম বড়ুয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে শুক্রবার ১৭৪ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে নতুন করে ২৮ জনের দেহে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। ফলোআপ পজিটিভ মিলেছে ৬ জনের। এই ৩৪ জনের মধ্যে একজন বান্দরবানের নাইক্যংছড়ি উপজেলার বাসিন্দা আর বাকিরা কক্সবাজারের।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২১ মে) ১৬২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৭ জনের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। পাশাপাশি রামু ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৮ জন এবং চকরিয়া ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালের একজন পুরাতন করোনা রোগীর ফলোআপ রিপোর্ট আবারও পজিটিভ পাওয়া যায়। বাকী ১৩৬ জনের নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে। বৃহস্পতিবার করোনা পজিটিভ আসা ১৭ রোগীর ১৬ জন কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। বাকি একজনের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলায়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রোগীর পরিসংখ্যান বাড়ার সঙ্গে করোনার উপসর্গ নিয়ে ধীরে ধীরে মৃতের সংখ্যাও দীর্ঘ হচ্ছে। করোনায় বৃহস্পতিবার (২১ মে) রাতে মারা যান কক্সবাজার শহরের বড় বাজার জামে মসজিদ এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ‘ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার’র সহ-সভাপতি হাজী নুরুল আবছার। ওইদিন রাত ১০টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন থেকে চট্টগ্রাম রেফার্ড করা হলে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে জানিয়েছেন সাতকানিয়া-লোহাগাড়া সমিতি’র সহ-সভাপতি ব্যবসায়ী আবদুর রহমান।
একইদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান শহরের বৈদ্যঘোনার বাসিন্দা মহিউদ্দিন (৪৫)। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান বলে দাবি করেন আরএমও ডা. শাহীন আবদুর রহমান। মৃত্যুর পর সংগ্রহ করা নমুনায় শুক্রবার তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে।
অন্যদিকে ওই রাতেই করোনার উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চকরিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা শহীদ হোছাইন চৌধুরী (৭৫)। অবশ্য তাকে আরও কয়েকদিন আগে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার মৃত্যু সনদে করোনার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এর আগে বুধবার (২০ মে) ভোরে নিজ বাড়িতে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান শহরের তারাবনিয়ারছরার বাসিন্দা খোরশেদ আলম। তিনি টেকনাফের হ্নীলার নয়াবাজার এলাকার মৃত হাজী আলী মিয়া দফাদারের ছেলে ও তারাবনিয়ার ছরার স্থায়ী বাসিন্দা। ১৭ মে তার নমুনা নেয়া হয় এবং ২০ মে মৃত্যুর পর রিপোর্ট আসে তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন।
আর কক্সবাজারে করোনার উপসর্গ নিয়ে সর্বপ্রথম মৃত্যুবরণ করেন রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের পূর্ব কাউয়ারখোপ গ্রামের মো. আবদুল্লাহর স্ত্রী ছেনু আরা বেগম। গত ৩০ এপ্রিল রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তির ৬ ঘণ্টার মাথায় তিনি মারা যান। পরে রিপোর্টে তার করোনা পজিটিভ এসেছিল।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের করোনা পরীক্ষার ল্যাবের রিপোর্ট মতে, কক্সবাজারের ৮টি উপজেলা, ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া-সাতকানিয়া থেকে সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হয় প্রতিদিন। এ ল্যাবে গত ৫১তম দিনে পরীক্ষার আওতায় এসেছে ৪ হাজার ৭৬৭ জন সন্দেহজনক রোগী। করোনা পজিটিভ এসেছে ৩৪৩ জনের। এদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ৩০৭ জন করোনা আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় ১০৫ জন, কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৯০ জন, পেকুয়া উপজেলায় ২৮ জন, মহেশখালী উপজেলায় ১৮ জন, উখিয়া উপজেলায় ৪১ জন, টেকনাফ উপজেলায় ৯ জন, রামু উপজেলায় ৭ জন, কুতুবদিয়া উপজেলায় ২ জন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২১ জন রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও ১১ লাখ রোহিঙ্গার ৩৪ ক্যাম্প শুরুতেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। অসচেতন জনতা চোর-পুলিশ খেললেও কঠোরতার কারণে দীর্ঘ দুই মাস কক্সবাজারে করোনার প্রাদুর্ভাব কমই ছিল। করোনা মুক্ত ছিল রোহিঙ্গা ক্যাম্পও। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে সম্প্রতি লকডাউন সীমিত ঘোষণার পর অবিবেচকভাবে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। ফলে কক্সবাজারে এখন করোনা পজিটিভের সংখ্যা বাড়ছে। এরপরও যথাযথ চিকিৎসা প্রয়োগ হওয়ায় মৃত্যুর হার কমই রয়েছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অর্ধশত রোগীও।
তিনি বলেন, আমরা এখনও বলছি, সচেতনতা ছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাব কমানো অসম্ভব। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমরা সচেতন হলে করোনার গতি ধরে রাখা সম্ভব।
সায়ীদ আলমগীর/আরএআর/পিআর