আজকের দিনে নড়াইলকে শত্রুমুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা
ঐতিহাসিক নড়াইল শত্রুমুক্ত দিবস আজ ১০ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে নড়াইল জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়।
এদিন সকালে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইল পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে ঘাঁটি গেড়ে থাকা পাকবাহিনীর দোসর মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকারদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করেন। দুপুরের পরপরই অনেকে পালিয়ে যায় এবং ২৬ জন মিলিশিয়া বাহিনীর ও রাজাকার সদস্য আত্মসমর্পণ করে।
নড়াইল ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর রণাঙ্গণ। কমান্ডার ছিলেন মেজর মনজুর। অন্যদিকে পাকবাহিনীর মোতায়েন ছিল ১০৭ ব্রিগেড। এর কমান্ডার ছিল ব্রিগেডিয়ার হায়াত আলী খান। তখন যশোর সেনানিবাস থেকে নড়াইল জেলাসহ ৬টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করা হত। ১০ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কোনো সহযোগিতা ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলকে শত্রুমুক্ত করেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশ যখন উত্তাল তখন ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুর মোহম্মদ স্যারের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা শরীফ হুমায়ূন কবির, খায়রুল ইসলাম, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি আবু সাঈদ, শেখ আজিবর রহমান, সাইফুর রহমান হিলু প্রমুখ মুক্তিকামী জনতা তৎকালীন নড়াইল মহকুমার এসডিও কামাল উদ্দীন সিদ্দিকীর কাছে ট্রেজারির চাবি চান।
তিনি চাবি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে চাপাচাপির এক পর্যায়ে তালা ভেঙে গোলাবারুদ লুট করা হয়।
২৯ মার্চ সকালে যশোর ঝুমঝুমপুর বিহারী কলোনী আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়। দুপুরের দিকে ট্রাকে করে মুক্তিকামী মানুষদের হামিদপুর বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ঝুমঝুমপুর বিহারী কলোনী আক্রমণ করা হয়।
এ সময় এগারখান এলাকা থেকে কয়েকশ নমশুদ্র শ্রেণির মানুষ হেঁটে ডাল, সড়কি, বল্লম নিয়ে বিহারী কলোনী আক্রমণে সহযোগিতা করেন। কলোনীর সদস্যরা আক্রমণকারিদের দিকে সোডার বতল (কাচের টুকরা দিয়ে তৈরি এক ধরণের হাত বোমা) ছুড়তে থাকেন।
অনেকে আহত হয়ে নড়াইল মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হন। বিহারী কলোনী থেকে প্রায় শতাধিক বিহারীদের ধরে এনে নড়াইল ডাক বাংলোয় আটকে রাখা হয়।
৩০ মার্চ তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে চিত্রা নদীর নড়াইল ফেরিঘাটে কোমর পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিকেলের দিকে বাকিদের লঞ্চে করে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
৭ এপ্রিল নড়াইল মহকুমা শহরের ওপর দিয়ে পাক বিমান বাহিনীর একটি প্লেন থেকে এসডিও অফিসে সেল মারা হয়। সেই সেল পাশের মুন্সেফ আদালতের বটগাছের ওপর পড়ে। এতে বটগাছের কয়েকটি মোটা ডাল ভেঙে যায় এবং পাশের কাঞ্ছিরাম ময়রার দোকান আগুনে পুড়ে যায়।
প্লেন থেকে আবারও এসডিও অফিসকে লক্ষ করে সেল ছোড়া হয়। তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মহকুমা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের সামনে পড়ে। সেলটি মাটিতে পুঁতে যায়। প্লেন থেকে আরেকবার চেষ্টা করা হলে এবার পড়ে নড়াইল থানার সামনের চিত্রা নদীতে।
মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু জানান, ৭ ডিসেম্বর সকালে ছাত্রলীগ নেতা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ভিক্টোরিয়া কলেজের একজন অধ্যাপকের বাড়িতে অবস্থান করেন। এ সময় ওই অধ্যাপক জানতে পেরে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীর লোকদের খবর দেন। তখন মিলিশিয়া বাহিনী বাড়ি ঘিরে ফেললে অনেকে পালিয়ে যান। কিন্তু মিজানুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা পালাতে না পারায় তাকে তারা ধরে ফেলে।
তখন মিলিশিয়া বাহিনীর লোকেরা মিজানুর রহমানকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা শেষে বাঁশের লাঠির সঙ্গে বেঁধে শহরময় ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়।
এ খবর জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা ৯ ডিসেম্বর বিকেলে রূপগঞ্জ বাজারের চিত্রা নদীর পূর্ব পাড়ে পংকবিলা, বোড়াবাদুড়িয়া, হাটবাড়িয়া নদীর তীরে ঘাঁটি গাড়েন। মিত্র বাহিনীর কোনো সহযোগিতা ছাড়াই ১০ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা চিত্র নদী পার হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে অবস্থান নেয়া মিলিশিয়া এবং রাজাকারদের ক্যাম্পে তিন দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করেন।
এ সময় ২৬ জন রাজাকার এবং মিলিশিয়াদের আটক করা হয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুজিব বাহিফনীর নড়াইল মহকুমা কমান্ডার শরীফ হুমায়ূন কবির বলেন, রাজাকার সোলায়মানের নেতৃত্বে অনেক মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে সাবেক মুন্সেফ আদালত সংলগ্ন চিত্রা নদীর লঞ্চঘাটের পল্টুনে জবাই করে হত্যা শেষে নদীতে ফেলে দেয়া হত। মানুষকে জবাই করার জন্য তারা ৬ জন জল্লাদকে কাজে লাগাত। রাজাকাররা নড়াইলের প্রায় তিন হাজারের ওপরে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে।
পরে এখানে নড়াইল বন্ধুসভা নামে একটি সামাজিক সংগঠন জঙ্গল পরিষ্কার করে ওইদিন সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে থাকে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে এনে এ প্রজন্মের সামনে সেই ইতিহাস তুলে ধরার অনুষ্ঠান করে থাকে। বধ্যভূমি হিসেবে এখন সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজাকারের প্রধান সোলায়মান তুলারামপুর এলাকা থেকে কয়েকজনকে ধরে এনে তাদের হত্যা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের পশ্চিম পাশে গণকবর দেয়। গণকবরটি বাধাই করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে নড়াইলের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামসম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছর সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
হাফিজুল নিলু/এফএ/এমকেএইচ