রাঙামাটিতে হাতির আক্রমণে বেড়েছে প্রাণহানি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি রাঙ্গামাটি
প্রকাশিত: ০৮:০৮ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২১

রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাই পাহাড়ি সড়কে প্রতিনিয়ত হাতির আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বনবিভাগের তথ্যমতে, গত দুইবছরে এই সড়কে হাতির আক্রমণে ছয়জনের মৃত্যুসহ আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

সড়কটি গত এক দশক আগে ব্যবহার শুরু হলেও প্রথম সাত-আট বছর এই সড়কটিতে হাতির উপদ্রব তেমন একটা ছিল না। কিন্তু গত দুই বছর ধরে এই সড়কে হাতির আতঙ্ক বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, হাতির আবাসস্থলগুলোতে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও হাতির খাদ্য সঙ্কটের কারণে তারা লোকালয়ে চলে আসছে।

এছাড়া সড়কটি নির্মাণের পর হাতির চলাচল কিংবা তাদের খাদ্য সংস্থান নিয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে বারবার হাতির আক্রমণের শিকার হচ্ছে এই সড়কটি ব্যবহার করা সাধারণ মানুষ।

বনবিভাগ ও স্থানীয়রা জানায়, গত এক দশক আগে সম্পূর্ণ পাহাড়ি পথে কাপ্তাইয়ে ১৮ কিলোমিটার আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কটি নির্মাণ করা হয়। দিগন্তবিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদের পাশ দিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এই সড়কটিকে স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে দ্রুত পরিচয় করে দেয়। সময়ের ব্যবধানে সড়কটির মুগ্ধতা দেশ-বিদেশে এতটাই প্রচার লাভ করে যে, প্রতিদিন এই সড়কে কয়েক হাজার মানুষ ভ্রমণ করতে করেন।

সড়কটির ব্যবহার এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এক দশকের মাথায় আবারও সড়কটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে এলজিইডি। বর্তমানে এই সড়কটি ২৪ ফুট প্রশস্ত করার কাজ চলমান রয়েছে। শহরের আসামবস্তি থেকে কামিলাছড়ি আগরবাগান প্রকল্প-২ পর্যন্ত প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার সড়কে হাতির তেমন চলাচল নেই। আগরবাগান প্রকল্প-২ থেকে নেভি ক্যাম্প সড়ক পর্যন্ত শেষ প্রায় চার কিলোমিটার সড়কে হাতির চলাচল রয়েছে। এজন্য বন বিভাগ থেকে হাতি চলাচলের স্পটগুলোতে সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। কিন্তু সড়কটি নির্মাণের পর প্রথম সাত-আট বছর তেমন একটা সমস্যা না হলেও বর্তমানে খাবার সঙ্কটের কারণে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে খাদ্য সংস্থানে যাচ্ছে হাতি। আর এতে বিভিন্ন সময়ে হাতির মুখোমুখি হচ্ছে এই সড়ক ব্যবহারকারীরা।

অভিযোগ রয়েছে, এলাকাটিতে পূর্বে তেমন একটা ঘরবাড়ি না থাকলেও সময়ের ব্যবধানে এসব স্থানে ঘর নির্মাণ ও বাগান তৈরির কারণে হাতির নিজস্ব এলাকায় ঢুকে পড়েছে মানুষ। আগে সড়কটি দিয়ে প্রচুর মানুষ কাপ্তাইয়ে যাতায়াত করলেও বর্তমানে খুব বেশি জরুরি কাজ ছাড়া সড়কটি ব্যবহার করছে না। তবে যেসব স্থানে হাতির বিচরণ নেই, সেসব জায়গায় মানুষ অনায়াসে ঘুরতে যাচ্ছে। শুধুমাত্র কাপ্তাই থেকে এই সড়ক ব্যবহার করে পর্যটন স্পটগুলো আসতে মানুষের মনে ভীতি কাজ করছে।

কামিলাছড়ি এলাকায় গড়ে উঠা পর্যটন স্পট রাইন্যা টুগুনের নির্বাহী পরিচালক ললিত সি. চাকমা বলেছেন, ‘হাতি যেসব খাবার খায়, সেসব খাবার এখন তেমন একটা নেই। এতে তারা বাধ্য হয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় খাদ্য সংস্থানের জন্য যাচ্ছে। খাদ্য সংস্থানে যাওয়ার সময় হাতির মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। হাতির এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত খাবারের আবাদ বাড়ানো গেলে তবে হাতি নিজ এলাকায় খাবার পেয়ে যাবে।’

jagonews24

জীবতলী ইউপি চেয়ারম্যান সুদত্ত কার্বারি বলেন, ‘সড়ক পথে কাপ্তাই থেকে রাঙ্গামাটি যাতায়াতের জন্য আমরা এই সড়কটি ব্যবহার করে আসছি। আগে যাতায়াতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বছর দুয়েক আগে রাতে হঠাৎ সড়কে বন্য হাতির আনাগোনা শুরু হয়। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে দিনে-রাতে কয়েকজন মারাও গেছেন। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ছয় জনের গ্রুপ থেকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে মারার পর সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে পড়েছেন। তাই আপাতত এই সড়কটি ব্যবহারে লোকজনের মধ্যে ভীতি কাজ করছে।’

এদিকে কাপ্তাই সড়কটিতে হাতির আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত সড়কটি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে ইউএনও বেগম মুনতাসির জাহান জানিয়েছেন- ‘কাপ্তাই ইউনিয়নে পাঁচদিনের ব্যবধানেই বন্যহাতির আক্রমণে দুইজন নিহত হয়েছেন। এই এলাকার সর্বসাধারণের জন্য এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশনা দেওয়া হলো। বিশেষ করে সকাল ৯টার আগে এবং বিকাল ৫টার পরে কাপ্তাই-রাঙামাটি নতুন রাস্তায় চলাচল না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। পর্যটকদের অতি উৎসাহিত হয়ে হাতি চলাচলের করিডোরে বিঘ্নসৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে। উক্ত ক্রসিং বা করিডোরগুলোতে রোডসাইন দেওয়া আছে। মহান সৃষ্টিকর্তা সকলকে হেফাজত করুন।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, ‘বনে হাতির পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকার কারণে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খাবারের সংগ্রহে যাচ্ছে। তাদের জন্য যে করিডর করা হয়েছে, সেসব জায়গায় মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করছে, এতে খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে হাতি। হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। তারমধ্যে প্রথমেই হাতির চলাচলকারী স্পটগুলো চিহ্নিত করে সচেতনতার জন্য সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফেঞ্চিং বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে কাজ শুরু করা হবে। আগামী অর্থ-বছরে বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

শংকর হোড়/আরএইচ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।