ফরিদপুরে ইটভাটার পেটে যাচ্ছে ফসলি জমি

এন কে বি নয়ন এন কে বি নয়ন ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ১৩ মার্চ ২০২২

অডিও শুনুন

ফরিদপুরে ফসলি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছেই। যে হারে ফসলি জমি কমছে তাতে ভবিষ্যতে আবাদি জমির সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ৬ বছরে জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর আবাদি জমি হ্রাস পেয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা ১৭৮৬ সালে। মতান্তরে এ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮১৫ সালে। ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়েছে এখানকার প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ শেখ ফরিদুদ্দিনের নামানুসারে। এ জেলার পূর্বনাম ছিল ‘ফতেহাবাদ’। ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা সন ১৭৮৬ হলেও তখন এটির নাম ছিল জালালপুর এবং প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা জালালপুর থেকে বিভক্ত হয়ে এটি ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে।

গোয়ালন্দ, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি মহকুমা সমন্বয়ে ফরিদপুর জেলা পূর্ণাঙ্গতা পায়। বর্তমানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এই পাঁচটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর অঞ্চলের মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৩২ হাজার ৯১৮ হেক্টর। এর মধ্যে নিট ফসলি জমি ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫৮ হেক্টর। পতিত জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। এক ফসলি জমি ১৪ হাজার ১৭ হেক্টর। দো-ফসলি জমি ৭১ হাজার ৭১২ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমির পরিমাণ ৫২ হাজার ৪০৪ হেক্টর। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী ফরিদপুর জেলার মোট আয়তন ২০৭৩ বর্গ কিলোমিটার (৮০০ বর্গমাইল)। মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৬৯৭ জন।

ফরিদপুর সদর ও নয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত ৬ বছরে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে ফসিল জমির পরিমাণ। গত ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে জেলা জুড়ে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৮ হেক্টর। হ্রাস পেতে পেতে চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর আবাদি জমিতে দাঁড়িয়েছে।

জেলা-উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সর্বত্রই প্রতিদিন অবৈধভাবে আবাদি জমি ধ্বংস করে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। জাঙ্গালিয়া এলাকা থেকে ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে অবৈধভাবে মাটি খনন করে গাড়িতে জাংগালিয়া এবং বিলমান্দলার নতুন নির্মিত রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত মাটি নেওয়ার কারণে রাস্তার দুই পাশ ভেঙে যাচ্ছে।

ফরিদপুরে ইটভাটার পেটে যাচ্ছে ফসলি জমি

ফরিদপুর শহর ঘেঁষে বিভিন্ন গ্রাম এলাকার কৃষি জমিতে একের পর এক গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। এতে পরিবেশ ও ফসল উৎপাদন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

এদিকে পদ্মা নদী থেকে সারাবছর অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালি ও কৃষি জমির টপ সয়েলের সহজলভ্যতার কারণে এরইমধ্যে শহর সংলগ্ন ডিগ্রিরচর ইউনিয়নের সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকায় গড়ে উঠেছে এক ডজনেরও বেশি ইটের ভাটা। এর মধ্যে একেবারেই গ্রামীণ এলাকা আইজদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গিতে মাত্র ২০০ গজের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি ইটভাটা। এভাবে কৃষি জমির ওপর একের পর এক ইটের ভাটা গড়ে ওঠায় ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। সেইসাথে নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশগুলো বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের কারণে ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হচ্ছে। ইট ভাটার চিমনির ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগ ছড়াচ্ছে। ধোঁয়া ও ধুলা দূষণে বিষাক্ত হচ্ছে পরিবেশ।

ফরিদপুরে ইটভাটার পেটে যাচ্ছে ফসলি জমি

সরেজমিনে বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, আইজুদ্দিন মাতুব্বরের ডাঙ্গিতে কৃষি জমি ধ্বংস করে পাশাপাশি তিনটি ইটের ভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে চাঁন মিয়া ও লিয়াকত মাতুব্বরের দুটো পুরনো ভাটার পাশাপাশি আরশাদ ব্যাপারী মালিকানাধীন এবিবি ব্রিক নামে নতুন আরও একটি ইটের ভাটা স্থাপন করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কৃষি জমি নষ্ট করে ভাটা তৈরি হোক এটা আমরাও চাই না। তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তর কিভাবে তাদের অনুমতি দেয়?

সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফরিদপুরের নগরকান্দায় ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। ভাটা মালিকরা ফসলি জমি কেটে মাটি গিলে খাচ্ছে। এলাকা ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়।

ফরিদপুরে ইটভাটার পেটে যাচ্ছে ফসলি জমি

মাটি কাটছেন এমন একটি ফসলি জমির মালিক তালমা ইউনিয়নের বিলনালিয়া গ্রামের মোসলেম মোল্যা বলেন, মাটির ভালো দাম পাওয়ায় জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছি। জমির ফসলে তেমন লাভ না হওয়ায় মাটি বিক্রি করে পুকুর খনন করছি।

এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের সুনীল বিশ্বাস, কালি কুমার বালা, জয়দেব বিশ্বাস, সুতালীয়া গ্রামের অমর বিশ্বাস, ময়না গ্রামের মুকুল কুমার বোস, তারেক হোসেন, খরসুতি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আল মামুন রনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কৃষিকাজ করছি শৈশবকাল থেকেই। দাদা-বাবার হাত ধরে কৃষি কাজে হাতেখড়ি। আগে যে পরিমাণ জমিতে আমাদের পরিবার চাষাবাদ করত, এখন তার এক পঞ্চমাংশ জমিতে ফসল ফলাই।

ফরিদপুরে ইটভাটার পেটে যাচ্ছে ফসলি জমি

বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এম মোশাররফ হোসেন মুশা মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, আবাদি জমি হ্রাসের নানা ধরনের কারণের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের কৃষিক্ষেত্রে। প্রতিবছর বেশ কয়েক শতাংশ হারে কমছে ফরিদপুরের আবাদি জমির পরিমাণ।

নগরকান্দা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এনএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে কৃষি জমির ক্ষতি করা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ ড. হযরত আলী জাগো নিউজকে বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাড়ি ঘর নির্মাণ, ফসলি জমিতে ইটভাটা, পুকুর খননসহ নানা কারণে দিন দিন ফসলি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।