যুগ যুগ ধরে কুষ্টিয়ায় চাষ হয় মিনিকেট ধান: দাবি কৃষকের

আল মামুন সাগর আল মামুন সাগর , জেলা প্রতিনিধি কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ০৬:০৯ পিএম, ০১ নভেম্বর ২০২২
মিনিকেট ধান

দেশের উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির পছন্দের শীর্ষে রয়েছে মিনিকেট চাল। কিন্তু বাজারে মিনিকেট বলে যে চাল বিক্রি হয় আদতে সে জাতের কোনো ধানই নেই বলে দাবি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের। ফলে মিনিকেট ধানের অস্তিত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কয়েকদিন ধরে কুষ্টিয়ায় অনুসন্ধান চালায় জাগো নিউজ। কথা হয় একাধিক কৃষক, ধান-চাল ব্যবসায়ী, মিল মালিক, চালকল মালিক সমিতির নেতাসহ কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

অনুসন্ধানে কুষ্টিয়ায় মিনিকেট ধানের চাষাবাদ হয় বলে তথ্য মিলেছে। আমন এবং বোরো দুই মৌসুমেই জেলার কৃষকরা এ ধান চাষ করেন। আমন মৌসুমে ফলন কম হওয়ায় কেবল বীজ তৈরির জন্যই কৃষকরা মিনিকেট ধানের চাষ করেন। তবে ইরি-বোরো মৌসুমে কৃষক মাঠজুড়ে মিনিকেট ধানের চাষ করছেন। অন্য ধানের চেয়ে ভালো ফলন এবং দাম বেশি হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মিনিকেট ধান।

jagonews24

স্থানীয় কৃষকদের দাবি, দেশের অধিকাংশ জেলায় দীর্ঘদিন ধরে মিনিকেট ধানের চাষ হয়ে আসছে। তবে দক্ষিণবঙ্গের ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরায় ব্যাপকহারে মিনিকেট চাষ হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও কুষ্টিয়ায় মিনিকেট ধান চাষাবাদ হওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

মিনিকেট ধানের উৎপত্তি যেভাবে

দীর্ঘদিন ধরে মিনিকেট ধান চাষাবাদ করেন এমন কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তাদেরই একজন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বড় আইলচারা এলাকার কৃষক তোঁতা জোয়ার্দার। নিজের চাষ করা মিনিকেট ধানক্ষেতে বসেই কথা বলেন এ ধানের জাত নিয়ে।

তোঁতা জোয়ার্দার জানান, ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় দেশে রোপা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই সময় ভারত সরকার সে দেশের কৃষকদের চাষ করার জন্য ছোট ছোট প্যাকেটে ধান বীজ ও সার দিয়েছিল। সেই ধান বীজের কিছু প্যাকেট চোরাইপথে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরে কয়েকজন কৃষকের হাতে পৌঁছায়। ওই প্যাকেটের গায়ে ‘মিনিকিট’ লেখা ছিল। কৃষকরা ওই বীজ লাগিয়ে ব্যাপক ফলন পান।

jagonews24

পরবর্তী বছর কৃষকরা সেই ধান থেকে নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ শুরু করেন। ধানটি অতি সরু এবং ফলন বেশি হওয়ায় দিন দিন কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় সেই মিনিকেট ধান দেশে চাষাবাদ শুরু হওয়ার পর কৃষকরা নাম দেন ‘মিনিকেট’। সেই থেকে এই ধানটি বিভিন্ন জেলায় কম-বেশি চাষাবাদ হয়ে আসছে।

কুষ্টিয়ায় মিনিকেট ধানের চাষাবাদ

কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলায়ই কম-বেশি মিনিকেট ধানের চাষাবাদ হয়। তবে কুষ্টিয়া সদর এবং মিরপুর উপজেলার কৃষকরা এ ধান বেশি চাষ করেন। সাধারণত এটি রবি অর্থাৎ বোরো মৌসুমের ধান। তবে আমন মৌসুমেও বীজ তৈরির জন্য এ ধান চাষ করা হয়। ২০২২-২৩ রবি মৌসুম শুরু হবে জানুয়ারি থেকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কুষ্টিয়ায় এবার ৩৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সদর উপজেলার বড় আইলচারা এলাকার ধান চাষি শাজাহান জোয়ার্দার জানান, এ অঞ্চলের যারা মিনিকেট ধান আবাদ করেন তারা এখন নিজেরাই বীজ তৈরি করছেন। চলতি-ইরি বোরো মৌসুমে ডিসেম্বর মাস শুরু হলেই কৃষকরা তাদের জমিতে মিনিকেট ধান আবাদ শুরু করবেন। বি-আর ৮৬, ২৮, ২৬, ৫৭, ৮১ সহ ব্রি ধান ৬৩, ৮১ ও ব্রি ১০০ ধানও মিনিকেট ধানের মতো সরু।

jagonews24

দেশি জাতের এই ধানগুলো আবাদ না করে কৃষকরা কেন ভারতীয় জাত মিনিকেট ধান চাষের দিকে ঝুঁকছেন এমন প্রশ্নে কৃষক জাহাঙ্গীর জানান, এ ধানগুলোর চেয়ে মিনিকেটের ফলন বেশি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বিঘাপ্রতি অন্য ধানের ফলন যেখানে ১২-১৫ মণ সেখানে মিনিকেটের ফলন ২৪-২৫ মণ। আবার অন্য ধানের মণ যেখানে ১২০০-১৪০০ টাকা সেখানে মিনিকেটের মণ ১৬০০-১৮০০ টাকা।

আল-কামাল নামে আরেক কৃষক বলেন, বিঘাপ্রতি অন্যান্য ধান আবাদে যে খরচ হয় মিনিকেটেও সেই খরচ হয়। তবে অন্য ধানের চেয়ে মিনিকেটের পার্থক্য হচ্ছে এই ধান উচ্চ ফলনশীল এবং অন্য ধানের চেয়ে দাম বেশি।

মিনিকেট ধানের বৈশিষ্ট্য

২৮ জাতের ধানের মতো এই ধানটি সরু ও লম্বা। তবে ধানটি নিচের দিকে ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা। অন্যান্য ধান যেখানে ৯০ থেকে ১০০ দিন সময় লাগে সেখানে মিনিকেট ৮০ দিন বয়স হলেই কাটা যায়।

মিনিকেট নিয়ে চালকল মালিক ও নেতাদের বক্তব্য

দেশে মিনিকেট চালের অন্যতম প্রবক্তা বাংলাদেশ অটোমেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও রশিদ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আব্দুর রশীদ বলেন, ব্যবসায়ীরা ধান উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। কৃষকের ধান কিনে চাল করে বাজারে বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের কাজ। কৃষক বাজারে ধান নিয়ে এসে যে নাম বলে সে নামেই ব্যবসায়ীরা চাল বিক্রি করে।

তিনি আরও বলেন, মিনিকেট ধান নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো মানে হয় না। সরকারকে হয় মিনিকেট ধানের জাতকে স্বীকৃতি দিতে হবে নতুবা মিনিকেট ধান চাষ করা যাবে না মর্মে ঘোষণা দিতে হবে। তাহলেই তো সবকিছু মিটে যায়। আমার কথা হচ্ছে, সেই আশির দশক থেকে আমাদের কৃষকরা কম-বেশি এ ধানের চাষ করছেন তাহলে এটার স্বীকৃতি দিতে বাধা কোথায়?

বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বলেন, মোটা ধান কেটে বা ছেঁটে পালিশ করে মিনিকেট চাল বলে বিক্রি করার যে অভিযোগ সেটি একদমই মিথ্যা। কেননা মিনিকেট নামে তো দেশে ধানই রয়েছে। কৃষকরাই এ ধান চাষাবাদ করছে।

jagonews24

দেশে আমন এবং বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ মিনিকেট ধান চাষাবাদ হয়ে থাকে সেটি কী দেশে মিনিকেট চালের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন প্রশ্নে চালকল মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, বিষয়টি সাংঘর্ষিক। তবে কৃষকরা মিনিকেটের মতো সরু এবং চিকন একাধিক দেশি জাতের ধানও চাষ করে থাকেন।

জয়নাল আবেদীন আরও বলেন, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধি দল মিনিকেট ধানের অস্তিত্ব আছে কী না তা যাচাইয়ে কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন। আমরা তখন ওই প্রতিনিধি দলকে সরেজমিনে মাঠে নিয়ে গিয়ে মিনিকেট ধান দেখিয়েছিলাম। তারা কৃষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলেন। ওই প্রতিনিধি দল সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং সবার সঙ্গে কথা বলে মিনিকেট বলে যে ধান আছে তা স্বীকার করে ঢাকায় ফিরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

কৃষি বিভাগের বক্তব্য

‘মিনিকেট’ নামে ধানের জাত আছে এবং এই ধান কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আবাদ হয় বলে স্বীকার করেন কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক ড. হায়াৎ মাহামুদ।

তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেলায় বিশেষ করে সদর এবং মিরপুর উপজেলায় মিনিকেট ধানের চাষা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে কুষ্টিয়া জেলায় তিন হাজার ১৫৩ হেক্টর জমিতে মিনিকেট ধানের চাষা হয়েছিল। তবে সরকারের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ ধানের জাতটি স্বীকৃত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এমআরআর/এএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।