যশোরে রেকটিফাইড স্পিরিটে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত মদ, কাড়ছে প্রাণ

মিলন রহমান মিলন রহমান , জেলা প্রতিনিধি, যশোর
প্রকাশিত: ০৫:১০ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩
ফাইল ছবি

যশোরে একের পর এক প্রাণ নিচ্ছে রেকটিফাইড স্পিরিটে তৈরি বিষাক্ত মদ। গত তিন বছরে বিষাক্ত এ মদপানে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ তিনজন মারা গেছেন।

মদপানে মৃত্যু ও অসুস্থের খবর প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এরপর কিছুদিন তোড়জোড় থাকলেও পরে আবার তা থিতিয়ে যায়। ফলে সহজেই মেলে রেকটিফাইড স্পিরিট। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, গত ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি যশোর সদর উপজেলার আবাদ কচুয়া গ্রামে রেকটিফাইড স্পিরিটে তৈরি ‘বিষাক্ত মদ’ পানে মৃত্যু হয় তিনজনের। এরা হলেন যশোর সদর উপজেলার আবাদ কচুয়া গ্রামের মৃত আবদুল হামিদের ছেলে ইসলাম (৪৫) ও শাহজাহান আলীর ছেলে জাকির হোসেন (২৯) এবং আবু বক্কর মোল্লার ছেলে আবুল কাশেম (৫৫)।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে যশোর সদরের আবাদ কচুয়া গ্রামের একটি বাগানে একই গ্রামের ইসলাম, আবুল কাশেম ও জাকির হোসেন এবং সিতারামপুর গ্রামের বাবলু হোসেন ও রিপন হোসেনসহ আরও দুজন বিষাক্ত মদ পান করেন। তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে গ্রাম্যচিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেন। অবস্থায় অবনতি হলে ইসলামকে পরদিন ভোরে (২৬ জানুয়ারি) তথ্য গোপন করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুরের দিকে তিনি মারা যায়। পরিবারের সদস্যরা দ্রুত ছাড়পত্র ছাড়াই মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান।

অন্য চারজনও অসুস্থ হয়ে পড়লে শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সকালে তারা একে একে যশোর হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জাকির হোসেন দুপুর পৌনে ১টার দিকে মারা যান। এরপরই নেশাজাতীয় দ্রব্য পানের বিষয়টি জানাজানি হয়।

আরও পড়ুন: যশোরে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩

ঘটনা জানাজানি হলে বাবলু ও রিপন হোসেন হাসপাতাল ছেড়ে বেসরকারি ক্লিনিকে সরে পড়েন। বর্তমানে তারা খুলনায় চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। আর শুক্রবার রাতে মারা যান আবুল কাশেম।

এরআগে ২০২০ সালের ১৭ জুন যশোরের ঝিকরগাছায় নেশাজাতীয় দ্রব্য পানে রাজাপুর গ্রামের হাবিল গাজী ও নুর ইসলাম খোকা, বর্নি গ্রামের ফারুক হোসেন, হাজিরালী গ্রামের আসমত আলী, পুরন্দরপুর গ্রামের হামিদুর রহমান এবং ঋষিপাড়ার নারায়ণের মৃত্যু হয়।

একই বছরের ২৫ ও ২৬ এপ্রিল নেশাজাতীয় দ্রব্য পানে মৃত্যু হয় ১০ জনের। যশোর সদর উপজেলার শেখহাটি কালীতলা এলাকার শাহিন, যশোর শহরের বেজপাড়ার নান্নু, শহরতলির ঝুমঝুমপুর মান্দারতলার ফজলুর রহমান, শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের মনিবাবু, ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের সাবু, যশোর শহরের বারান্দি মোল্যাপাড়ার বাসিন্দা মদের দোকানের কর্মচারী আব্দুর রশিদ, চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলার আক্তারুজ্জামান, ঝিকরগাছার কাটাখালী গ্রামের সাহেব আলী, মণিরামপুরের মোহনপুর গ্রামের মোমিন ও মোহনপুরের মুক্তার আলী মারা যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এদের বেশিরভাগ বিষাক্ত মদপানে অসুস্থ হয়ে মারা যান। আর এ মদ তৈরি হয় রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে। যশোরে বেশ কয়েকটি চক্র এরসঙ্গে জড়িত।

সূত্রমতে, যশোরের হোমিওপ্যাথিক দোকান ও ঢাকার মিডফোর্ড থেকে চক্রটি এ রেকটিফাইড স্পিরিট সংগ্রহ করে। প্রশাসনের অভিযানে মাঝে মধ্যে এ মদ ও রেকটিফাইড স্পিরিটের দু-একটি চালান ধরা পড়লেও সাধারণ সময়ে বেচাকেনা হয় অহরহ। কিন্তু এ মদ যখন বিষাক্ত হয়ে যায় তখনই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, আবাদ কচুয়ায় মাদক সেবনে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সেই মদ বিকিকিনির সঙ্গে জড়িত সীতারামপুর গ্রামের মনিরদ্দিনের ছেলে বাবলু এবং একই গ্রামের আনোয়ার মোড়লের ছেলে রিপন হোসেন মোড়ল। তারাও ওই মদপানে অসুস্থ হয়ে গোপনে চিকিৎসাধীন।

ওই ঘটনার পর আবুল কাশেমের মেয়ে নাছরিন খাতুন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। আসামি করা হয়েছে ওই এলাকার মদ বিক্রেতা বাবুলসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৪-৫ জনকে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেন, যশোরে সম্প্রতি যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, তারা রেকটিফাইড স্পিরিটে তৈরি মদপানে মারা গেছেন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনার পরপরই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঘটনার তদন্ত ও অভিযান শুরু করেছে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকানসহ যেসব উৎস থেকে রেকটিফাইড স্পিরিট সংগ্রহের সুযোগ আছে, সেসব জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। অনুমোদন ছাড়া কোথাও এ স্পিরিট বিক্রির সুযোগ নেই। বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা হবে।

যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, আবাদ কচুয়া গ্রামের ঘটনায় অসুস্থরা তথ্য গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হয়। ওই ঘটনায় মৃত আবুল কাশেমের মেয়ের মামলা আমলে নিয়ে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, এ বিষাক্ত মদের বেচাকেনা ও তৈরির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।