দুষ্প্রাপ্য ফসল চিয়ায় স্বপ্ন বুনছেন লালমনিরহাটের কৃষক
স্বল্প খরচ ও কম সময়ে ঘরে তোলা যায় চিয়া। আবার বাজারে চিয়ার ভালো দামও পাওয়া যায়। তাই তামাক বাদ দিয়ে দুষ্প্রাপ্য ফসল চিয়ায় স্বপ্ন বুনছেন লালমনিরহাটের কৃষকরা। চিয়া চাষে এখানকার মাটি উপযুক্ত হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ভালো লাভের আশা করছেন কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালে লালমনিরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ ও হাতীবান্ধা উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুকের উদ্যোগে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ও হাতীবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নে পাঁচ একর জমিতে প্রথম চিয়া চাষ শুরু হয়। সরকারিভাবে চিয়া বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়। এবার জেলায় সাত একর জমিতে চিয়া চাষ হয়েছে।
উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের কৃষক জাহিদুল ইসলাম (৪০) প্রথমবারের মতো সুপারফুড চিয়া বীজ চাষ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার ৪০ শতাংশ জমিতে প্রায় ৭৬ কেজি চিয়ার ফলন পান। ৭০০-১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন চিয়া। পাশাপাশি অন্যদেরও বীজ দিয়ে চিয়া চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন।

কৃষক জাহিদুল ২০২১-২০২২ অর্থবছরের রংপুর বিভাগের শ্রেষ্ঠ কৃষকের পুরস্কার পান। চিয়া চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাতীবান্ধা উপজেলার অনেক কৃষক ক্ষতিকর তামাক চাষ বাদ দিয়ে সুপারফুড চিয়া চাষে ঝুঁকছে।
জাহিদুল ইসলাম গতবছর ১০ কেজি চিয়া বীজ কুড়িগ্রাম, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিক্রি করেন। ওই এলাকার কৃষকরাও বীজ পেয়ে চিয়া চাষ শুরু করেন।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চিয়া বীজ সালভিয়া হিসপানিকা নামক মিন্ট প্রজাতির উদ্ভিদের ভোজ্য বীজ। এটি মধ্য যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মরুভূমি এলাকার উদ্ভিদ। চিয়া বীজ দেখতে অনেকটা তোকমা দানার মতো। আকারে তিলের মতো সাদা ও কালো রঙের হয়ে থাকে। এক বিঘা জমিতে চিয়া চাষে সার, বীজ, সেচ ও পরিচর্যা বাবদ খরচ হয় ৭-৮ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘায় ১০০-১২০ কেজি চিয়া ফলন পাওয়া যায়। প্রতি কেজি চিয়া বীজের বাজার মূল্য ৮-১২০০ টাকা।

চিয়া বীজ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ বপন শেষ হয়। মার্চ মাসের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। এর ফসল ঘরে তুলতে সময় লাগে ১০০-১২০ দিন। চিয়া তুলে ইরিধান লাগানো যায়। চিয়া চাষে খরচ কম লাগে, অন্য ফসলের তুলনায় বেশি লাভবান। চিয়া চাষ করে জমিতে তিন ফসল করা যাবে।
হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের পূর্ব সারডুবী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ জমির চারিদিকে সবুজের সমারোহ। বাতাসে দোল খাচ্ছে চিয়া গাছের নীল রঙের বাহারি ফুল। দূর-দূরান্ত থেকে চিয়া গাছ দেখার জন্য আসছে লোকজন। নতুন ফসল চাষের আগ্রহ প্রকাশ করছেন কৃষকরা।
সারডুবী গ্রামের কৃষক মনছুর আলী বলেন, জাহিদুল ভাইয়ের পরামর্শে প্রথমবারের মতো ৮০ শতাংশ জমিতে চিয়া চাষ করেছি। জমিতে চিয়ার ভাল ফলন হয়েছে। গতবছর এ জমিতে তামাক চাষ করেছিলাম। এবার তামাকের পরিবর্তে চিয়া চাষ করেছি। ভালো ফলন ও দাম পেলে সামনের বছরে আরও বেশি করে চাষ করবো। চিয়া চাষ করে ভাগ্য বদলাতে চাই আমরা।

আদর্শ কৃষক জাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলার সাবেক ডিসি শামীম আশরাফ আমাকে প্রথম চিয়ার বীজ দেন। ৪০ শতাংশ জমিতে লাগাই। তাতে অন্য ফসলের তুলনায় চিয়ায় বেশি লাভ হয়। সেই থেকে এলাকার কৃষকদের ক্ষতিকর তামাক চাষ বাদ দিয়ে চিয়া আবাদে উদ্বুদ্ধ করি। এ বছর লালমনিরহাট জেলায় প্রায় সাড়ে ৭ একর জমিতে চিয়ার চাষ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এলাকার অন্য কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে তামাক চাষের পরিবর্তে চিয়া চাষ করছে। এটাই আমার বড় পাওয়া। আমি হাতীবান্ধা উপজেলাকে শতভাগ তামাক মুক্ত উপজেলা করতে চাই।
হাতীবান্ধা কৃষি কর্মকর্তা সুমন মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, চিয়া সিড চাষে কৃষকদের সবরকম পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমাদের দেশে চিয়া চাষ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। উপজেলায় তিন থেকে চার একর চাষাবাদ হয়েছে। আগামীতে আরও বেশি পরিমাণ জমিতে চিয়ার আবাদ হবে। চিয়া একটি ঔষধি ফল। চাষ করে কৃষকরা লাভবান হবেন।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হামিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, চিয়া বীজে প্রচুর পরিমাণ আ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যার ফলে শরীরের শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়ে। এ বীজ ত্বক, নাক ও চুল সুন্দর রাখে এবং ক্যানসার রোধ করে। ব্লাড সুগার স্বাভাবিক রাখে এবং ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
তিনি আরও বলেন, জেলায় এ বছর প্রায় সাত একর জমিতে চিয়া চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দুই একর জমি বেড়েছে। জেলায় তামাকের পরিবর্তে চিয়ার আবাদে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে। আগামীতে আরও বেশি পরিমাণ জমিতে চিয়া চাষের প্রস্তুতি আছে।
এসজে/এমএস