ছিটমহলে ৪০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচার শুরু
পঞ্চগড়ের শালবাড়ি ছিটমহলে ৪০ বছর আগে খুন হয়েছিলেন আজিমুল হক নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। সেসময় কোনো দেশের নাগরিকত্ব না থাকায় মামলা করতে পারেননি নিহতের স্বজনরা। অবশেষে নতুন বাংলাদেশি হয়ে প্রচলিত আইনে ১৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন নিহতের ছোট ভাই আরিফুল ইসলাম।
আদলতের নির্দেশে শনিবার বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহল থেকে নিহতের দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয়। বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক, বোদা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) সংশ্লিষ্টরা মরদেহ উত্তোলন কাজ তদারকি করেন। দীর্ঘদিন পর হলেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সন্তুষ্টি জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যসহ স্থানীয়রা।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে ২ সেপ্টেম্বর বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহলে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে খুন হন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিমুল হক। ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় বিচার বঞ্চিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। নতুন বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার পর গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর নিহতের ছোট ভাই বাদী হয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার আসামিরা হলেন, ওই ছিটমহলের আব্দুর রহমান, খলিলুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, জসিয়ার রহমান, নজরুল ইসলাম, তছিরউদ্দিন, সিদ্দিক, নাজমুল হক, মজিমউদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, ইউনুস শেখ, বাবুল হোসেন ও মো. দিপু।তাদের মধ্যে আব্দুর রহমান, নজরুল ইসলাম ও তছির উদ্দিনসহ চারজন মারা গেছেন। বাকি ৯ জন আসামি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কৃষ্ণ কান্ত রায় মামলাটি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে বোদা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি বোদা থানায় মামলাটি রুজু করা হয় এবং পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিষয়টি তদন্ত করে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেন। এরপর মামলার অধিকতর তদন্তের স্বার্থে আদালত ওই মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু আউয়ালের উপস্থিতিতে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা মো. রাজিউল করিম রাজু, বোদা থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বোদা থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) দীন মোহাম্মদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কবর খননকারী দল ওই মুক্তিযোদ্ধার দেহাবশেষ ও মাটিসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন।
নিহতের স্বজনরা জানান, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষরা মুক্তিযোদ্ধা আজিমুল হককে প্রথমে বিষ মাখানো তীর দিয়ে বিদ্ধ করেন এবং পরে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। তৎকালীন ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় কোনো চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতেও পারেনি জাতীর এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। প্রচলিত আইন ও বিচারিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন তারা। কিন্তু গত বছরের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের পর ছিটমহলবাসীরা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। এরপর নিহত মুক্তিযোদ্ধা আজিমুল হকের ছোট ভাই আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।
এদিকে ৪০ বছর পর মরদেহ উত্তোলনের খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিলুপ্ত ছিটমহলের শত শত নারী পুরুষ সেখানে ভিড় জমান। দীর্ঘদিন পর হলেও নিহতের পরিবার প্রচলিত আইনে হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার পাবেন এই আশায় বুক বেধেছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের নতুন এই বাংলাদেশিরা।
প্রতিবেশি সরফরাজ হোসেন, ইউসুফ আলী, আজিজার রহমানসহ কয়েকজন জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিমুল হকের সঙ্গে চাচাতো ও জ্যাঠাতো ভাইদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধাকে আসামিরা দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা চালান। প্রথমে তাকে বিষ মাখানো তীর দিয়ে আহত করেন এবং পরে তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহলের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় আজিমুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার জানামতে তার পরিবারের কাছে সার্টফিকেটসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কাগজপত্র রয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বোাদা থানার এসআই দ্বীন মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ১৩ আসামির মধ্যে চারজন মারা গেছেন। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত আছে।
বোদা থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি মামলাটি বোদা থানায় রেকর্ড করা হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করলে আদালত ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেন।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা মো. রাজিউল করিম রাজু জাগো নিউজকে বলেন, মরদেহের দেহাবশেষ, মাটিসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে আলামতসমূহ ঢাকা রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে।
বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আউয়াল জাগো নিউজকে বলেন, ছিটমহলে আগে প্রচলিত কোনো আইন ছিল না। এজন্য তারা আইনি সহায়তা পাননি। বাংলাদেশ ঘোষণার পর বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী আরিফুল ইসলামের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৪০ বছর পর বড় ভাই হত্যার বিচার শুরু হয়েছে।
সফিকুল আলম/এমজেড/আরআইপি