চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু হবে কবে?
ব্রিটিশ আমলে প্রসিদ্ধ ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল উত্তরের জেলা নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি। সে সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠানসহ গড়ে ওঠে শুল্ক স্টেশন ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। তবে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় এখানকার শুল্ক স্টেশন। ২০০২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় চেকপোস্টটিও।
এরপর বিভিন্ন সময় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষের দাবিতে ২০১৩ সালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে চিলাহাটি স্থলবন্দরের গেজেট প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১০ বছরেও কাগজ-কলমেই আটকে আছে উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ এ জেলার সেই চিলাহাটি স্থলবন্দর চালুর কাজ।
তবে চিলাহাটিকে আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে আইকনিক ভবন, তৈরি করা হচ্ছে সংযোগ রেললাইনসহ অন্য অবকাঠামো। এরই মধ্যে আইকনিক ভবন নির্মাণের কাজ ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে এবং সংযোগ রেললাইন স্থাপনের কাজ ৫০ শতাংশ হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্ম ও ফুটওভার ব্রিজ। এরই চিলাহাটি দিয়ে ভারতে যাতায়াত করছে আন্তঃদেশীয় ট্রেন মিতালি এক্সপ্রেস।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মানু্ষের দাবি, বন্দরটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে সাথে আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ বদলে যাবে এ অঞ্চলের জীবনমান। স্থলবন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি থাকা অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা বাড়বে।
এছাড়া সার্কভুক্ত ভুটান, নেপাল আর চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যোগ হবে নতুন এক মাত্রা। ঘুচবে বেকারত্ব। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ফলে দেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এতে দ্রুত পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের চিত্র। তবে এত সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও গেজেট হওয়ার পরও কেন চালু হচ্ছে না স্থলবন্দরটি প্রশ্ন স্থানীয়দের।
স্থানীয় বিমল চন্দ্র রায় বলেন, শুধু আমরা শুনি চালু হবে। আজ মন্ত্রী আসে, কাল অমুক আসে, কিন্তু চালু আর হয় না। এটা চালু হলে আর কিছু না হোক আমাদের আর বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে না। এখানেই অনেক কাজ বের হবে। নিজের এলাকায় কাজ করে জীবন চালাবো।

সিরাজুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, বন্দরটি চালু হলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান বদলে যাবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নীলফামারীকে নতুন করে চিনবে মানুষ। এটা আমাদের প্রাণের দাবি স্থলবন্দর টা হোক।
পাথর ব্যবসায়ী রউফুল ইসলাম বলেন, এ পোর্টটা চালু হলে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য কিছুটা বাড়বে। এখন পাথর আসছে তবে নানা জটিলতা আছে৷ সম্পূর্ণ চালু হলে আমরা ব্যবসাটা বাড়াতে পারি। সরকারও রাজস্ব পাবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এটির দাবি জানালেও সরকার কেন গেজেট দিয়ে আর উদ্যোগ নিচ্ছে না এটা আমাদের কাছে বড় প্রশ্ন।
স্থানীয় ইলিয়াস হোসেনের বাবা অসুস্থ প্রায় দুবছর৷ দুবার চিকিৎসার জন্য যেতে হয়েছে ভারতে৷ এর মধ্যে একবার গেছেন মিতালি এক্সপ্রেসে। তবে উত্তরবঙ্গ দিয়ে ট্রেন গেলেও উঠতে ঢাকায় যেতে হয়েছে।
ইলিয়াস হোসেন বলেন, বাবাকে নেওয়ার জন্য আমাদের ঢাকায় যেতে হয়েছে। ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা ঢাকায় গেলাম। আবার সেই ট্রেনে উঠে আবারও একই রাস্তা এলাম। কিন্তু এখানে যদি ইমিগ্রেশন থাকলে এত কষ্ট হতো না। স্থলবন্দর থাকলে আমাদের যাতায়াত, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু প্রসারিত হত।

নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সফিকুল ইসলাম ডাবলু জাগো নিউজকে বলেন, চিলাহাটি স্থলবন্দর চালুর জন্য আমরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ২০১৩ সালে গেজেট হলো আমরা স্বপ্ন দেখলাম শিগগির চালু হবে কিন্তু প্রায় একযুগ চলে যাচ্ছে এর কোনো পদক্ষেপ নাই৷ কবে হবে তা জানি না তবে যদি চালু হয় তাহলে এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ ঘুচবে। আমাদের ইপিজেডসহ এ অঞ্চলের কলকারখানায় মালামাল আমদানি রপ্তানিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। এটার দাবি আর কি জানাবো আমরা ক্লান্ত। তবে চাই যেন দ্রুত চালু হয়।
নীলফামারী প্রেস ক্লাবের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক তাহমিন হক ববি জাগো নিউজকে বলেন, চিলাহাটি স্থলবন্দরটি এ অঞ্চলের উন্নয়নের একমাত্র চাবিকাঠি। এটি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। তবে বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম হলেও এর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের গেজেটেই আটকে আছে এটি। স্থলবন্দরটি বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন হবে৷ তবে স্থানীয় মানুষজনও ক্লান্ত হয়েছে আন্দোলন করতে করতে।
তিনি আরও বলেন, ভুটানের প্রতিনিধি দল এসে পরিদর্শন করেছে। স্থানটিতে যেহেতু রেল যোগাযোগ আছে তারাও আগ্রহী চিলাহাটি দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনে। কিন্তু সবকিছুই আটকে আছে স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশনের ওপর।

এ বিষয়ে জানতে নীলফামারী শুল্ক ও আবগারী বিভাগীয় কার্যালয় গেলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, চিলাহাটি একটি সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক স্থান। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৩ সালে চিলাহাটি স্থলবন্দরের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এরপর থেকে এর কার্যক্রম আর সেভাবে এগোয়নি। আমরা এরই মধ্যে আরও একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। যাতে স্থলবন্দরটি সম্পূর্ণ চালু হয়।
তিনি আরও বলেন, যদি স্থলবন্দর সম্পূর্ণ চালু হয়, এ অঞ্চলে উন্নয়ন ঘটবে। একই সঙ্গে নীলফামারীসহ রংপুর বিভাগের অন্য জেলাও অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে এ এলাকার জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন আসবে।
রাজু আহম্মেদ/এসজে/এএসএম