‘ছেলের জন্য হলেও স্বামীর মরদেহটা যদি দেশে আনা যেত’
দুই মাসের গর্ভে রেখে বাবা মো. মনির আকন (৪৫) চলে যান সৌদি আরব। ছেলে রায়হানের বয়স এখন সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি। ভিডিও কলে কথা হলেও সামনাসামনি দেখা হয়নি বাবা-ছেলের। কিন্তু কখনো আর বাবার কোল পাবে না ছোট্ট রায়হান।
৯ জুন রাতে সৌদি আরবে রাস্তায় পড়েছিল মনিরের মরদেহ। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বিষয়টি নিহতের পরিবার জানতে পারে। এখন তার মরদেহে বাড়িতে আসার অপেক্ষায় আছে তারা।
পরিবারের দাবি, সরকারিভাবে মরদেহটি আনার ব্যবস্থা হলে ছোট্ট রায়হান তার বাবাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে পাবে।
সোমবার বিকেলে মাদারীপুর পৌর শহরের ৪ নম্বর শকুনি এলাকায় মনিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, সন্তান ও ছোট ভাই-বোন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। পাড়াপ্রতিবেশীরাও এসে ভিড় করছেন নিহতের বাড়িতে।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৃত সেকেন আকনের বড় ছেলে মনির আকন ধারদেনা করে ২০১৭ সালের জুনে সৌদি আরব যান। তেমন কোনো কাজ না পাওয়ায় উল্টো বাংলাদেশ থেকে তার পরিবার প্রায় টাকা পাঠাতেন। আকামার জন্য দেশ থেকে ধারদেনা করে টাকা পাঠালেও ওই দেশের মালিক তা করে দেননি। আজ-কাল করেও আকামা না হওয়ায় কোনো কাজই করতে পারছিলেন না মনির। তাই তিনি দেশেও আসতে পারেননি। এমনকি ছেলে রায়হানের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর হলেও মুখোমুখি বাবা-ছেলের দেখা হয়নি।
শুক্রবার (৯ জুন) সন্ধ্যায় মনিরের সঙ্গে তার ছোট বোন রোমানার শেষ কথা হয়। তখন মনির জানান তার বুকে অনেক ব্যথা হচ্ছে। তিনি ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে যাচ্ছেন। এরপর আর কথা হয়নি। সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের সেফা এলাকায় রাস্তার ওপর তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন ওই দেশের স্থানীয় লোকজন। খবর পেয়ে দেশটির পুলিশ মনিরের মরদেহ উদ্ধার করে।
রাস্তায় পড়ে থাকা ছবি শুক্রবার রাত থেকেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে নিহত মনিরের মরদেহের ছবি দেখে পরিবারের লোকজন সৌদি আরবে খোঁজ নেন। সেখানে নিহতের সর্ম্পকের এক খালাতো ভাই ইমনের কাছ থেকে মনির আকনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর থেকেই বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
মনিরের বৃদ্ধা মা জাহানার বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘এ শোক আমি কীভাবে সইবো। আল্লাহ আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন। কেন আমার ছেলেকে নিয়ে গেলেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে মনিরের বাবা মারা গেলেন। এরপর ২০২১ সালে বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে মেজ ছেলে ওহিদুজ্জামান আকনও মারা গেলো। এখন আমার বড় ছেলেও মারা গেলো। এত মৃত্যু আমি সইতে পারছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মনির অনেক দেনা করে সৌদি গিয়েছিল। সেখানে থেকে আমাদের কোনো টাকা পাঠাতে পারেনি। উল্টো আমরাই তার জন্য টাকা পাঠিয়েছি। আকামার জন্য ধার করে টাকা পাঠিয়েছিলাম। সেই আকামাও করে দেয়নি মালিক। ওর হার্টে সমস্যা ছিল। শ্বাসকষ্টও ছিল। হয়তো ওষুধ কিনতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে রাস্তায় বসেই মারা গেছে। এখন আমাদের একটাই দাবি ওর মরদেহটি যেন সরকার দেশে এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’
নিহতের বোন রোমানা বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে আমার শুক্রবার সন্ধ্যায় শেষ কথা হয়। তিনি বলেছিলেন তার বুকে অনেক ব্যথা করছে। ওই দেশে থাকেন বাংলাদেশের পরিচিত একজনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে ওষুধ কিনতে যান। সেই টাকাও বাংলাদেশের একজনকে আমাকে দিতে বলেছেন। অনেক দেনা আছে আমাদের। এ বাড়ি ছাড়া আমাদের কোনো জমি নেই যে, জমি বিক্রি করে ভাইয়ের মরদেহ আনবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরবে যারা আছেন, তারা জানিয়েছেন মরদেহ দেশে আনতে ৩ লাখ টাকা লাগবে। এ টাকা আমরা কোথায় পাবো। ভাইকে শেষ দেখা দেখতে চাই।’
নিহতের স্ত্রী মিনি বলেন, ‘বিয়ের চার মাস পর মনির সৌদি আরব চলে গেছেন। তখন রায়হান পেটে। দুই মাসের গর্ভবতী আমি। সেই ছেলে জন্ম হলো। দেখতে দেখতে সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেলো। অথচ আমাদের এমন ভাগ্য যে, বাবা-ছেলের মুখোমুখি দেখা হলো না। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে। তাই আমার ছেলের জন্য হলেও মনিরের মরদেহটা যদি দেশে আনা যেত।’
মনিরের ছোট্ট ছেলে রায়হান মারা যাওয়ার বিষয়টি তেমনভাবে না বুঝলেও, এতটুকু বুঝে সে আর তার বাবাকে কোনো দিন দেখতে পাবে না। রায়হান জানায়, বাবাকে দেখতে চাই।
মনিরের প্রতিবেশী মো. মিজানুর রহমান সৌদি আরবে থাকেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে রাস্তায় মনিরের মরদেহ পড়ে থাকার ছবি ফেসবুকে দেখি। এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ও মারা গেছে। ওর ছেলে এখনো তার বাবাকে দেখেনি, তাই আমরা এখান থেকে মরদেহ দেশে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। আমরা ৫০ হাজার টাকা দেবো। কিন্তু বাকি আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। তাই সবাই মিলে যদি একটু সহযোগিতা করতেন, তাহলে হয়তো মনিরের মরদেহ দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত।’
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কেউ যদি বৈধভাবে বিদেশ যায়, তাহলে অ্যাম্বাসি থেকেই মরদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। আর যদি অবৈধভাবে যায়, তাহলে অ্যাম্বাসি থেকে এ দেশের অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করে থাকে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো খবর পাইনি বা কেউ আমাদের এখনো এ খবর জানায়নি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসজে/জিকেএস