নৌকায় জীবন পার সিরাজুলের

আমিন ইসলাম জুয়েল আমিন ইসলাম জুয়েল , জেলা প্রতিনিধি ,পাবনা
প্রকাশিত: ০৮:৪২ পিএম, ২৯ জুন ২০২৩

পাবনার বেড়া উপজেলার মানিকনগর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম গত ২৬ বছর ধরে নদীর মধ্যে ভাসমান ঘর তুলে বসবাস করে আসছেন। পঙ্গুতের কারণে তার এমন জীবনযাপন। নদীতে মাছ ধরে কিংবা খেয়া পারাপার করে যে আয় হয় তাতে কোনোরকমে দিনাতিপাত করেন সিরাজ।

তিনি নিয়মিত এবাদত বন্দেগিও করেন কিন্তু পঙ্গুত্বের কারণে ২৬ বছর ধরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারেন না। ঈদের দিন তাকে কোলে করে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নামাজ পড়া হয় না।

jagonews24

পাবনার বেড়া উপজেলার মানিকনগর গ্রামের আফাজ উদ্দিনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম। একসময় গ্রামে গ্রামে ফেরি করে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।

জীবনের প্রায় ৭০ বছর পাড়ি দেওয়া সিরাজুল ইসলাম জানান, ১৬-১৭ বছর বয়স থেকে তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা বলতে অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি-পাতিলের ব্যবসা করতেন। কাঁধে বোঝা নিয়ে গ্রাম- গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। এরপর ২০-২২ বছর বয়সে কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। তিনি দুই ছেলে চার মেয়ের জনক। প্রায় তিন দশক সংসার করার পর তার পায়ে পচন দেখা দেয়। রোগের কারণে তার দুটি পা কেটে ফেলতে হয়।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি অন্যের গলগ্রহ হয়ে পড়ি। একা একা চলতে পারি না। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বাড়ির কাছে কাগেশ্বরী নদী। নানাকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিই, জীবনের বাকি সময় নদীতেই কাটিয়ে দেবো। কেন এমন সিদ্ধান্ত? তিনি জানালেন, নৌকায় তার অনেক সুবিধা। বৈঠা চালিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সহজেই যাওয়া যায়। টয়লেটে যেতেও সুবিধা। আর নদীতে খেয়া পারাপার এবং মাছ ধরতে পারলে কিছু টাকা পাওয়া যায়। এসব কারণে তিনি নৌকা জীবন বেছে নিয়েছেন।

jagonews24

সিরাজুল ইসলাম জানান, কাগেশ্বরী নদীতে ১২ মাসই পানি থাকে। এবছরে চরম খরার বছরও পানি রয়েছে। ঋতুভেদে পানি কম-বেশি হয়। এজন্য তার ভাসমান খুপরি ঘরটি ড্রামের ওপর নির্মিত। এতে পানি কম-বেশি হলেও তার সমস্যা হয় না।

তিনি জানান, ২৬টি বছর তার এই খুপরি ঘরেই কাটছে। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্র সব উপেক্ষা করে নৌকাতেই পড়ে থাকেন। যাত্রী পারাপারে দিনে কিছু টাকা রোজগার হয়। আর নদীতে জাল পাতেন। ভাগ্য ভালো থাকলে হাজার টাকার মাছও পান। তবে গড়ে তিনি দিনে এক-দুইশ টাকার মাছ পেয়ে থাকেন। কোনোদিন মাছই পান না। এভাবে কিছু টাকা আয় হয়। আর গ্রামের সবাই তাকে ভালবাসেন। তারা খুশি হয়ে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেন।

সিরাজের বসবাস, খাওয়া-দাওয়া ২৬ বছর ধরে খুপরি ঘরেই চলছে। তিনি জানান, বাড়ি থেকে তাকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। তিনি মনের তাড়নায় বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। আসলে তিনি কারও গলগ্রহ হতে চাননি।

রান্না বা খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে জানান, বাড়ি থেকে রান্না করে দেওয়া হয়। সরকারের কাছে কোনোকিছু চাওয়া পাওয়ার আছে কি না, এ বিষয়ে জানান, তিনি চলাফেরা করতে পারেন না, তাই নদীতেই বসবাস করেন। বছর দুয়েক আগে নদীর পাড়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তোলা হয়। তিনি সেখানে একটি ঘর চেয়েছিলেন। তিনি জানান, নদীর পাড়েই যেহেতু আশ্রয়ণের ঘর তাই তিনি সেখান থেকে নদীতে নৌকা চালাতে পারতেন। এতে তার সুবিধা হতো। তবে ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাননি। এ নিয়ে তার তেমন আফসোসও নেই।

সিরাজ জানান, তার খুপরি ঘরটি তৈরি করতে কিছু আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীরা সহযোগিতা করেছেন। কেউ ড্রাম কিনে দিয়েছেন, কেউ নৌকা তৈরি করে দিয়েছেন, বাঁশের খুঁটি দিয়েছেন। এভাবেই তিনি খুপরি ঘরটি করেছেন। ঘরে আলো জ্বলে কীভাবে বা বদ্ধ জায়গায় কীভাবে থাকেন, এ প্রশ্নে জানান, প্রতিবেশীরা তাকে একটি বৈদ্যুতিক লাইন দিয়েছেন। এছাড়া একজন একটি ব্যাটারি দিয়েছেন। বিদ্যুৎ চলে গেলে সেই ব্যাটারি থেকে লাইট এবং পাখা চালান।

এত প্রতিকূল জীবনযাপন করার পরও তার নৌকায় দেখা যায়, লজ্জাবতী ফুল থেকে শুরু করে কয়েক রকম ফুলের গাছ, মাল্টা গাছ। সিরাজ জানান, তিনি শখ করে এসব গাছ লাগিয়েছেন। নৌকাতে এরাই তার প্রতিবেশী।

jagonews24

মানিকনগর গ্রামের বাসিন্দা লাল ইসলাম, ফিরোজ মোল্লা, সিদ্দিকুর রহমান জানান, তারা ছোটবেলা থেকেই তাকে নদীতে বসবাস করতে দেখছেন। তিনি খেয়া পারাপার এবং নদীতে মাছ ধরে জীবন চালান। তিনি এলাকায় একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত।

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আরশেদ মোল্লা জানান, সিরাজুল দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নদীতে বসবাস করনে। তার কাজকর্ম তিনি নিজেই করেন। মাছ ধরে কিছু আয়- রোজগার করেন। তিনি ভিক্ষা করে জীবন চালান না। তবে গ্রামের মানুষ খুশি হয়ে তাকে কিছু সাহায্য সহযোগিতা করেন।

বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সবুর আলী জানান, তিনি বিষয়টি জানতে পেরেছেন। তিনি চাইলে তাকে তাকে ঘর দেওয়া হবে। না হলে তাকে অন্যভাবে সহযোগিতা করা হবে।

এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।