শোকে বাকরুদ্ধ স্বজনরা
যশোরে বাসের ধাক্কায় নিহত ৭ জনের দাফন সম্পন্ন
যশোর-মাগুরা মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় নিহত সাতজনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
শনিবার (৮ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুরে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় মাঠে তিনজন, সেকেন্দারপুর গ্রামে দুইজন, মথুরাপুর গ্রামে একজন এবং সদর উপজেলার সুলতানপুরে একজনের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে, নিহতদের পরিবারে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। শোকে বাকরুদ্ধ স্বজনরা। পরিবারের সদস্যদের কারও মুখে কথা নেই, সবাই যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
শুক্রবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যায় যশোর সদর উপজেলার তেঁতুলতলা বাজারে যশোর-মাগুরা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তিন শিশু, নারীসহ সাতজন নিহত হন। এরমধ্যে একই পরিবারে পাঁচজন ছিলেন।
নিহতরা হলেন যাদবপুর গ্রামের হেলাল মুন্সির দুই যমজ ছেলে হাসান ও হোসাইন (২), হেলাল মুন্সির শাশুড়ি মাহিমা (৪৩), খালা শাশুড়ি রাহিমা খাতুন ও তার মেয়ে জেবা (৮), মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে ইজিবাইকচালক মুসা (২৭) এবং সুলতানপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে ইমরান হোসেন (২৬)।
এসময় হেলাল মুন্সির স্ত্রী সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হন। তাদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার অবনতি হলে সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
শুক্রবার মধ্য রাতেই বাড়িতে পৌঁছায় হেলাল মুন্সির যমজ দুই ছেলে ও শাশুড়ির মরদেহ। এরপর খালা শাশুড়ি ও তার মেয়ে জেবার মরদেহ পাঠানো হয় পাশের গ্রাম মথুরাপুরে। হেলাল মুন্সি ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। ঘটনার দিন সকালে তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই এ দুর্ঘটনার খবর পান। দুই ছেলেসহ নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এরমধ্যে হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন স্ত্রী ও বড় মেয়ে। এতে নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি।
হেলাল মুন্সি বলেন, সাজানো সংসার ছিল আমার। একটা দুর্ঘটনায় সব শেষ। আমার কলিজার দুই হাসান-হোসেন কই, তাদের ছেড়ে আমি কীভাবে থাকবো?
তিনি বলেন, হাসপাতালে আমার মেয়ে আর বউটা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। কী হবে আমার। যাদের সুখের জন্য আজ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় কাজ করি; তারাই আজ নেই। সব শেষ আমার।
আহত সোনিয়ার চাচা ছোটন হোসেন বলেন, খাদিজার গলায় টিউমার ছিল। তা অপারেশনের জন্য শুক্রবার বিকেলে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি ক্লিনিকে যাচ্ছিল। পথে লেবুতলা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এতে আমাদের পরিবারের পাঁচ জন মারা যায়। এছাড়া আমার ভাইঝি সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল রাতেই সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। খাদিজা যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
অপরদিকে, একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামে প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বাড়িতেও একই দৃশ্য দেখা যায়। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নার রোলে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম জানান, রাহিমা বেগম ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা স্বজনদের সঙ্গে যশোরে ক্লিনিকে যাওয়ার পথে মারা যান। তার ভাই সাইদুল ইসলাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দুয়েক আগে তিনি দেশে এসেছিলেন। সাইদুলের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সুমাইয়া শিরিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে রিফা তামান্না পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জেবা তাহিরা এবছর স্কুলে ভর্তি হয়।
জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, এই ইউনিয়নে এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা এর আগে কখনো দেখিনি। একই পরিবারে পাঁচজনসহ সাতজন মারা যাওয়াতে ইউনিয়নজুড়েই শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, নিহত ও আহতদের সবর ধরনের সহযোগিতা আশ্বাস দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। একইসঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবেও সহযোগিতার চেষ্টা করবো।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, লেবুতলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ইজিবাইক চালকসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন আছেন। বাস ও ইজিবাইকটি পুলিশ জব্দ করেছে। এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি এবং কাউকে আটকও করা যায়নি।
জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, নিহতদের দাফন ও আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা হবে।
মিলন রহমান/এমআরআর/এমএস